চোখে না দেখা অবধি যদি বিশ্বাস না-ও করা যায়, তা হলেও প্রশ্ন— গোটা দুনিয়া জুড়ে যখন একের পর এক চরম আবহাওয়া-জনিত বিপর্যয় ঘটেই চলেছে, তখনও বিশ্বের তাবড় নেতারা জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন কী ভাবে? সব নেতা ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো নন, সে কথা সত্যি— ট্রাম্প যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের বিজ্ঞানকেই মানতে রাজি নন, সেখানে এমন নেতাও আছেন, যাঁরা শতমুখে এই বিপদের গুরুত্ব স্বীকার করেন, কিন্তু নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে স্বার্থ রক্ষা করেন ব্যবসায়ী মহলের। জল-হাওয়া-জঙ্গল-পাহাড়, সবের অপব্যবহারের অবাধ অধিকার তুলে দেন ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের হাতে। রাষ্ট্রনায়করা কেন অলিগার্ক-দের স্বার্থরক্ষায় নিবেদিতপ্রাণ, সে কথা বুঝিয়ে না বললেও চলবে; কিন্তু সেই নেতাদের যারা ভোট দিয়ে ক্ষমতায় আনে— কোথাও কোথাও টানা তিন বারও— সেই জনতা কী ভাবে ভুলে যায় পরিবেশের বিপদের কথা, নিজেদের জীবনে সেই বিপদের প্রত্যক্ষ এবং ভয়ঙ্কর প্রভাবের কথা?
দুনিয়া জুড়ে পরিবেশবাদীরা এই প্রশ্নের একটা সহজ, এবং অবধারিত ভাবে ভুল উত্তর দিয়ে থাকেন— সাধারণ মানুষের কাছে জলবায়ু পরিবর্তন সম্বন্ধে যথেষ্ট তথ্য নেই বলেই তাঁরা যথেষ্ট সচেতন নন। কথাটা বহু মাত্রায় ভুল। প্রথমত, গবেষণা দেখিয়েছে যে, জলবায়ু পরিবর্তন সম্বন্ধে বেশি তথ্য জানলে বরং কিছু করার তাগিদ কমে। কেন, তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা আছে, কিন্তু সে প্রসঙ্গ অন্যত্র। কথাটা হল, পরিবেশের বিপদ সম্বন্ধে মাত্র দুটো কথা জানলেই তো যথেষ্ট হয়— এক, বাতাসে কার্বন ডাইঅক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইডের মতো গ্যাস বাড়লে জলবায়ু ক্রমে উষ্ণতর হয়ে উঠতে থাকে; এবং দুই, সেই উষ্ণতর জলবায়ুর কারণে ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সংখ্যা এবং তীব্রতা বাড়ে। সেই বিপর্যয়ে কতখানি বিপদ, তা জানতে তো আর পণ্ডিতদের দেওয়া তথ্যের প্রয়োজন নেই— মানুষ নিজের চোখেই দেখছে খরা, বন্যা, দাবানল আর ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতা। তার পরও নেতারা পরিবেশের প্রশ্নে গা না করলে মানুষ তা সহ্য করে কেন? আক্ষরিক অর্থেই যা জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন, সেই পরিবেশ কেন রাজনীতির মূল বিষয় হয়ে ওঠে না?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে মানুষের মনের দ্বারস্থ হতে হবে। প্রথমত, মানুষের মেনে নেওয়ার এবং মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা বিপুল। ভেবে দেখুন, এই যে বছর-বছর গরম বেড়েই চলেছে, আমরা কি তার সঙ্গে মানিয়ে নিই না? শোয়ার ঘরে এসি লাগাচ্ছি, দিনে তিন বার স্নান করছি, কিন্তু আদৌ কি বলছি যে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে এখনই আরও কঠোর, আরও সক্রিয় পদক্ষেপ করতে হবে সরকারকে? বলছি না, তার সবচেয়ে বড় কারণ হল, আমরা বিশ্বাস করি যে, এ দাবি করে কোনও লাভ নেই। সরকার আমাদের দাবি শুনবে না। এবং, যদি বা আমাদের দেশের সরকার শোনে, জলবায়ু পরিবর্তনের মতো একটা বৈশ্বিক সমস্যার সমাধান করার সাধ্য তার নেই। যে সমস্যা সমাধান করা যায় না বলেই মন জানে, তার সমাধানের সম্ভাবনাকে মন আর গ্রাহ্য করে না।
কিন্তু, একটা মস্ত সমস্যা আছে, যার সমাধান হচ্ছে না— এই চিন্তা মনকে শান্তিও দেয় না। আচরণবাদী মনস্তত্ত্বের ভাষায়, এতে একটি ‘কগনিটিভ ডিসোন্যান্স’ তৈরি হয়, যার একটা গ্রহণযোগ্য সমাধান খুঁজে বার করতে হয় মনকে। তার মধ্যে একটা হল সম্পূর্ণ বিপদটাকেই অস্বীকার করা। বিশ্বাস করা যে, জলবায়ু পরিবর্তন আদৌ ঘটছে না। আজ বিপর্যয়ের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে কেউ যে এমন একটা কথায় বিশ্বাস করতে পারে, সেটা যদি ভাবা কঠিন হয়, তবে সহজতর ভাবনাটি হল— জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে কি না, কারও পক্ষেই সে কথা নিশ্চিত করে জানার উপায় নেই। হচ্ছে, অথবা হচ্ছে না, বিশ্বাস করতে হবে দুই মতামতের মধ্যে কোনও একটিকে। এখানে এসেই মানুষের মনের দখল নিতে চায় পলিটিক্যাল ইকনমি।
যে কোনও বিষয়ের মতোই, পরিবেশ বিদ্যার ক্ষেত্রেও ‘জ্ঞান’ বস্তুটি উৎপন্ন হয়। সেই গবেষণার জন্য বিস্তর টাকা লাগে। ১৯৫০-এর দশক থেকে পেট্রোলিয়ামের মতো শিল্প বুঝে নিয়েছিল, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে অদূর ভবিষ্যতে শুরু হবে বিপুল হইচই। সেই আগুন লাগার আগেই কুয়ো খুঁড়তে শুরু করে তারা— নিজেরাও ‘জলবায়ু পরিবর্তন’ সংক্রান্ত ‘গবেষণা’র কাজ শুরু করে; অন্য দিকে, বিবিধ দক্ষিণপন্থী রক্ষণশীল গবেষণা প্রতিষ্ঠান, থিঙ্ক ট্যাঙ্ককে টাকা দিতে থাকে। লক্ষ্য একটাই: এমন ‘জ্ঞান’ উৎপাদন করতে হবে, যা অস্বীকার করবে বিশ্ব উষ্ণায়নের বিপদকে। সেই অনুযায়ী তৈরি হয়েছে বিপুল জ্ঞানের ভান্ডার— সংবাদমাধ্যম, জনসংযোগ সংস্থা, এবং গত এক-দেড় দশকে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে নিয়মিত ছড়িয়েও পড়েছে সেই জ্ঞান। অর্থাৎ, জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যাটির ব্যাপ্তি বা গুরুত্ব কতখানি, ‘জ্ঞানচর্চা’র মাধ্যমে কেউ সে কথা বুঝতে চাইলে তাঁর সামনে থাকবে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী দু’গোত্রের ‘জ্ঞান’— তিনি কোনটা বেছে নেবেন, সেটা তাঁর বিবেচনা।
অথবা, সেই বিবেচনাটিও তৈরি করে দিতে পারে পলিটিক্যাল ইকনমি। আমেরিকায় যেমন দীর্ঘ দিন ধরে বিশ্ব উষ্ণায়নের বিরুদ্ধে লড়াইকে দাঁড় করানো হয়েছে দেশের, এবং সাধারণ মানুষের আর্থিক উন্নতির বিপক্ষে। বলা হয়েছে, উষ্ণায়ন নিয়ে বাড়াবাড়ি আসলে ‘সোশ্যালিস্ট’দের চাল— এই পথে তারা নষ্ট করতে চায় আমেরিকার ‘ফ্রি স্পিরিট’, ব্যক্তির স্বাধীনতা। নাগরিকের উপরে চাপিয়ে দিতে চায় রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ। মিলটন ফ্রিডম্যানের মতো নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ বলেছেন, সব প্রাকৃতিক সম্পদের কুশলীতম ব্যবহারের পথ বাতলে দিতে পারে বাজারই— তার জন্য রাষ্ট্রের, অথবা কোনও নিয়ন্ত্রক সংস্থার খবরদারির প্রয়োজন নেই। রাজনৈতিক ভাবে দক্ষিণপন্থী মানুষের কাছে স্বভাবতই এই কথাগুলো গ্রহণযোগ্য ঠেকেছে। এবং, তাঁরা বেছে নিয়েছেন উষ্ণায়নের বিপদকে অস্বীকার করার ‘জ্ঞান’। যত বেশি কথা বলেছেন এই মতবাদে বিশ্বাসী অন্যান্য মানুষের সঙ্গে, তত দৃঢ়তর হয়েছে নিজের বিশ্বাস। আচরণবাদী অর্থশাস্ত্র যাকে বলে ‘ইকো চেম্বার’— নিজেরই মতামত প্রবলতর হয়ে নিজের কাছে ফিরে আসে যেখানে, এবং আরও বেশি বিশ্বাসযোগ্য ঠেকে।
যাঁদের দক্ষিণপন্থী বিশ্বাস গোড়ায় এতখানি মজবুত ছিল না, তাঁদের কাছেও ক্রমশ পৌঁছতে থাকে জলবায়ু পরিবর্তনকে অস্বীকার করার ‘জ্ঞান’। তাঁরা দেখতে পান যে, চার পাশের অনেকেই বলছে সে কথা। এমনকি, নেতারাও জনসভায় এসে বলছেন, এ সব নিয়ে এত মাথা ঘামানোর দরকার নেই। অন্য দিকে, জলবায়ু পরিবর্তনের চরিত্র এমনই যে, খালি চোখে তাকে ঠাহর করা মুশকিল— চল্লিশ বছর আগের গ্রীষ্মে কতখানি গরম পড়ত, বছরে ক’বার ঘূর্ণিঝড় হত, সে হিসাব কারও কাছে না থাকাই স্বাভাবিক। ফলে, জলবায়ু কতখানি পাল্টাল, এক দিকে সে কথা জানা নেই; আর অন্য দিকে বারে বারে শোনা যাচ্ছে যে, এটা আসলে একটা চক্রান্ত— এই দুইয়ের মধ্যে মানুষের মন কোন দিকে ঝুঁকবে, বুঝতে সমস্যা নেই।
রাজনীতিকরা জানেন, নেতাদের মানুষ প্রশ্ন করে তখনই, যখন তাদের মনে হয় যে, সরকারের যা করার কথা, সরকার তা করছে না। মানুষ যদি জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদকে সত্যিই এই মুহূর্তের সবচেয়ে বড়, বা অন্যতম বড় বিপদ বলে মনে করে, একমাত্র তখনই সরকারের দিকে আঙুল তুলবে সে বিষয়ে সক্রিয় না হওয়ার জন্য। মানুষের মনকে যদি সে কথাটায় বিশ্বাসই করতে না দেওয়া হয়, তা হলে আর বাকি ল্যাঠা থাকে না। নেতারা জানেন, বিশ্ব উষ্ণায়নের গোটা ব্যাপারটাই ধাপ্পা, এতখানি বোঝানোরও দরকার নেই— মানুষ শুধু এটুকু ভাবলেই যথেষ্ট যে, এই মুহূর্তে বিশ্ব উষ্ণায়নের চেয়ে বড় সমস্যা আছে। তা হলে, উষ্ণায়নের সমস্যা নিয়ে পরে ভাবলেও চলবে।
কত পরে, সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার দায় রাজনীতিকদের নেই। মসনদে তাঁদের মেয়াদটুকু কেটে গেলেই তাঁরা নিশ্চিন্ত।