জলের আকাল
গরম তীব্র হতেই চড়া দামে জল কিনতে হচ্ছে কলকাতার বাসিন্দাদের। এ কেবল জলের অভাব নয়, জল সরবরাহে দুর্নীতি এবং যথাযথ ব্যবস্থার অভাব। নিয়ম না মেনে একটি বাড়িতে একাধিক জলের সংযোগ, পুরসভার জলের পাইপ থেকে অবৈধ ভাবে জল উত্তোলন, ভূগর্ভের জলের যথেচ্ছ ব্যবহার, এ সবই চলছে পুরকর্তাদের নাকের নীচে। ‘টাইম কল’-এর সামনে নানা আকারের পাত্রের দীর্ঘ সারি, পুরসভার জলের গাড়ির সামনে মানুষের ভিড়, এ সব দেখে যার তীব্রতা আন্দাজ করা যায়। পুরসভার জলের গাড়িতেও এক-একটি এলাকার সব বাসিন্দার পাত্র ভরে না। বিত্তবান হয়তো পুরসভার জলের গোটা একটি গাড়ি তলব করতে পারেন, স্বল্পবিত্ত মানুষ তা পারেন না। ফলে প্লাস্টিকের বোতল, কিংবা বড় জার-ভর্তি জল কিনতে হয়। যা কার্যত একটি দুষ্টচক্র, কারণ বাড়তি চাহিদা মেটাতে এগিয়ে আসে বেশ কিছু ভুঁইফোঁড় সংস্থা, যাদের না আছে ব্যবসার জন্য বৈধ অনুমোদন, না জলের মান পরীক্ষার কোনও ব্যবস্থা। স্থানীয় নেতা বা পুরকর্তাদের গোপন সহায়তায় এই সংস্থাগুলি অবাধে জল তুলছে ভূগর্ভ থেকে, এবং বোতলে ভরে বিক্রি করছে। জলের চাহিদা এখন এমনই যে, মুদির দোকান বা মিষ্টির দোকানেও বড় বড় পাত্রে জল বিক্রি হচ্ছে। তাতে ভূগর্ভের জল নষ্ট হচ্ছে, জলের মান নিয়ে প্রশ্ন থাকছে, আবার প্লাস্টিক দূষণও অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়ছে। যা কেবল দুর্নীতিই নয়, ইঙ্গিত দেয় নীতির ব্যর্থতার প্রতি। সব শ্রেণির মানুষের সঙ্গতির কথা ভেবে পানীয় জলের উপর জলকর না বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুরসভা। অথচ, প্রবল গ্রীষ্মে জল কিনে খেতে গিয়ে যে বোঝা চাপছে নাগরিকের উপর, তা সম্বৎসরের সম্ভাব্য করের তুলনায় বহুগুণ বেশি।
সাংবাদিকদের কাছে অনেক নাগরিক এই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যে, জলকর না নেওয়া বস্তুত সরকারের বদান্যতা নয়। কর নিলে যথেষ্ট পরিমাণে উন্নত মানের জল সরবরাহের যে নৈতিক দায় চাপে, তা এড়াতে চায় পুরসভা। এই ধারণার সত্যতা বিচার সম্ভব নয়, তার প্রয়োজনও নেই। এমন সংশয় যে জাগতে পেরেছে, সেটাই পুরসভার পক্ষে লজ্জাজনক। মেয়র ফিরহাদ হাকিম আশ্বাস দিয়েছেন, জলের উৎপাদন বেড়েছে, আগামী বছর আরও বাড়বে। কিন্তু উৎপাদন বাড়ানোই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন অপচয় রোধ করা। তার জন্য কী ব্যবস্থা করা হচ্ছে? পাঁচ বছর আগে প্রস্তাব এসেছিল যে কলকাতার কোন ওয়র্ডে জলস্তরের অবস্থা কেমন, তা বোঝাতে লাল, কমলা ও সবুজ রঙের সঙ্কেত দিয়ে তার মানচিত্র প্রকাশ করবে পুরসভা। আজ অবধি তা
প্রকাশিত হয়নি। অথচ, ২০১৮ সালেই একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার রিপোর্টে ভারতের শীর্ষ পাঁচটি জলের অভাবে সঙ্কটাপন্ন শহরের (ওয়াটার-স্ট্রেসড সিটিজ়) একটি হল কলকাতা। বিভিন্ন সময়ে নানা সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে, কলকাতার কোনও কোনও এলাকায় জলস্তর পাঁচ ফুট থেকে সাত ফুট নেমে গিয়েছে। কলকাতার বেশ কয়েকটি ওয়র্ড আর্সেনিক দূষণের জন্য চিহ্নিত হয়ে রয়েছে। এগুলিতে জলস্তর নামার পরিণাম কত ভয়ানক হতে পারে, অজানা নয়।
সর্বপ্রথম প্রয়োজন সঙ্কটের স্বীকৃতি। কাগজে-কলমে মাথাপিছু বরাদ্দ জলের পরিমাণ পুরসভা যা-ই দেখাক, বাস্তব এই যে বিপুল-সংখ্যক মানুষের প্রতি গ্রীষ্মে জলের অভাবে ভোগান্তির শেষ থাকে না। এর মূল রয়েছে দুর্নীতিতে— কিছু টাকার বিনিময়ে অবৈধ ভাবে নির্মিত বাড়িতে জলের সংযোগ দেওয়া হচ্ছে। পাম্প লাগিয়ে পুরসভার মূল লাইন থেকে জল তোলার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। বড় আবাসনগুলিতে গভীর নলকূপ বসানোয় বাধা দেওয়া হচ্ছে না। নাগরিক জল পাচ্ছেন না, পুরসভা রাজস্ব হারাচ্ছে। জলের অপব্যবহার, অতি-ব্যবহার বন্ধ করা দরকার। পাশাপাশি, বৃষ্টির জল পুনর্ব্যবহারে জোর দেওয়া দরকার। জল সংরক্ষণ ও অপচয় রোধের একটি যথাযথ রূপরেখা প্রকাশ করা জরুরি।