বিজ্ঞাপনে বাহারি কলকাতা
দক্ষিণের বারান্দায় গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করতে আসা লোকেরা এক দিন সিঁড়ির নীচে আবিষ্কার করলেন ঝকঝকে এক নতুন সাইকেল। চোখে পড়ার মতো ঘটনা, কারণ তখনও কলকাতার রাস্তায় সাইকেল বেশ দুর্লভ। জিজ্ঞেস করায় গগনেন্দ্রনাথ বললেন, তাঁর সাইকেলের শখ হয়েছে, তাই কিনেছেন। ক’দিন পর কিন্তু সে সাইকেল আর বাড়িতে দেখা গেল না। কেউ কেউ খোঁজ করলেন, কিন্তু মালিকেরও সদুত্তর পাওয়া গেল না। আসলে কারণটা ছিল অন্য। উত্তাল সেই সব দিনে ঠাকুরবাড়িতেও আনাগোনা ছিল বিপ্লবীদের, দ্রুত খবর আদানপ্রদানের জন্য তাঁদের একটা সাইকেল না হলেই চলে না। গগনেন্দ্রনাথ তাই চৌরঙ্গীর এক অভিজাত দোকান থেকে কিনে এনেছিলেন বিলিতি সাইকেলটি। গোপনে সেই সাইকেল পৌঁছেও গিয়েছিল বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, কানাইলাল দত্তদের ডেরায়।
তখন ওল্ড কোর্ট হাউস স্ট্রিট থেকে চৌরঙ্গি রোড ধরে পর পর সাহেবি দোকান। তাদের নতুন নতুন পণ্য ও পরিষেবা সম্পর্কে ক্রেতাদের জানাতে খবরকাগজে ছাপা হত বিজ্ঞাপন। মূলত ইংরেজি কাগজে এলকিংটনের রুপোর বাসনপত্র, গ্যারার্ড অ্যান্ড কোম্পানির গয়না বিজ্ঞাপনে দেখে ভিড় জমাতেন ক্রেতারা। চা ও তামাকের শৌখিন নেশার হাতছানির পাশেই গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের বেকারি নজর কাড়ত। হল অ্যান্ড অ্যান্ডারসন-এর হালফ্যাশনের পোশাকের পাশে অসলার কোম্পানির দৃষ্টিনন্দন বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের বিজ্ঞাপন মনে করাত শহর কলকাতায় শুরু হওয়া বিদ্যুৎ পরিষেবার কথা। বাঙালি অভিজাতদেরও টানত এই সব দোকান। সত্যজিৎ রায়ের যখন ছোট ছিলাম স্মৃতিকথায় ‘হোয়াইটআওয়ে লেইডল’ বিপণিতে খেলনা কেনা ও প্রথম লিফ্ট চড়ার বর্ণনায় ধরা আছে বিকিকিনি আর সময় কাটানোর মুগ্ধতা।
বিজ্ঞাপনগুলি খুঁটিয়ে দেখলে এই সব সংস্থা ও বিপণির পণ্য সংক্রান্ত তথ্যের পাশাপাশি সেই সময়ের কলকাতাবাসীর রুচির ধারণাও পাওয়া যায়। বোঝা যায়, কলকাতার অভিজাত শ্রেণির পছন্দে অনেকটাই প্রভাব ছিল ইংল্যান্ডের অভিজাত সমাজের। গগন ঠাকুরের সেই সাইকেল নিয়ে ঠাকুরবাড়ির দৌহিত্র মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখায় আর কোনও তথ্য না পাওয়া গেলেও, কাগজের বিজ্ঞাপন থেকেই জানা যায়— সে সময় র্যালে কোম্পানির তৈরি সাইকেল ছাড়াও, আজ মোটরবাইকের জন্য বিখ্যাত বিলেতের এনফিল্ড কোম্পানির সাইকেলও বিক্রি হত কলকাতায়।
সাহেবিয়ানা-কেন্দ্রিক এই সব বাণিজ্যিক প্রচার স্বাধীনতার পর প্রাসঙ্গিকতা হারাল। শুধু বিজ্ঞাপনগুলি রয়ে গেল কাগজের পাতায়। তেমনই নানা বিজ্ঞাপনে সমৃদ্ধ দি ইংলিশম্যান পত্রিকার বেশ কিছু সংখ্যা হাতে এসেছিল সংগ্রাহক অরুণাভ ঘোষের। ১৯১৩ সালে প্রকাশিত কাগজগুলির অবস্থা ছিল খুবই করুণ, কালস্রোতে হারিয়ে যাওয়ার আগে বাছাই কিছু বিজ্ঞাপন পুরনো কলকাতা নিয়ে আগ্রহীদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার পথ ভাবতে বসেন তিনি, ইতিহাস-গবেষক সাগ্নিক ভট্টাচার্যের সঙ্গে। দু’জনের সেই ভাবনাই রূপ পেয়েছে প্রসঙ্গ-লেখ সহ ৪৫টি বিজ্ঞাপন-কার্ডের সুদৃশ্য সেটে। শিরোনাম দিয়েছেন ওঁরা, ‘কমার্শিয়াল ক্যালকাটা: দ্য রাজ অ্যান্ড ইটস রিটেলারস’। তারই ৩টি ছবি উপরে।