উৎসাহিত শিল্প, দুশ্চিন্তায় সুদ নির্ভর অবসরপ্রাপ্তেরা
অমিতাভ গুহ সরকার
২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে ভারতীয় অর্থনীতির বৃদ্ধির হার ছিল ৬.৫%। যা চার বছরের সর্বনিম্ন। সেই আর্থিক কর্মকাণ্ডের চাকায় গতি ফেরাতে গত শুক্রবার মোক্ষম দাওয়াই পেশ করেছেন রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর সঞ্জয় মালহোত্র। শীর্ষ ব্যাঙ্কের ঋণনীতি কমিটি এক ধাক্কায় রেপো রেট (যে হারে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলিকে ধার দেয়) কমিয়েছে ৫০ বেসিস পয়েন্ট। এ ছাড়াও নগদ জমার অনুপাত বা সিআরআর (আমানতের যে অংশ নগদে ধরে রাখতে হয়) চার কিস্তিতে ১০০ বেসিস পয়েন্ট কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা। এর ফলে ঋণ দেওয়ার জন্য ব্যাঙ্কের হাতে নগদের পরিমাণ বাড়বে। তারা সুদও কমাতে পারবে দ্রুত। এই দুই পদক্ষেপ অর্থনীতিতে গতির সঞ্চার করতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট মহলের আশা। কারণ, এতে কম সুদে বেশি ঋণ পাওয়ার রাস্তা সুগম হবে। বাড়বে পণ্যের চাহিদা। যা শিল্পকে বেশি উৎপাদনে উৎসাহিত করবে। তবে একই সঙ্গে মেয়াদি আমানতের সুদ কমার আশঙ্কায় কিছুটা দুশ্চিন্তায় সুদ নির্ভর মানুষজন।
রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের অনুমান, চলতি অর্থবর্ষে মূল্যবৃদ্ধির হার ৩.৭ শতাংশের কাছাকাছি থাকবে, যা বেশ স্বস্তিদায়ক। তবে ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু করে তিন কিস্তিতে রেপো রেট মোট ১০০ বেসিস পয়েন্ট কমিয়ে ৫.৫ শতাংশে নামানো ও অদূর ভবিষ্যতে সিআরআর ১০০ বেসিস পয়েন্ট কমিয়ে ৩ শতাংশে নামানোর পরে সুদ ছাটাইয়ের আর তেমন পরিসর থাকবে না বলেই শীর্ষ ব্যাঙ্ক মনে করছে। পরবর্তী সিদ্ধান্ত হবে মূল্যবৃদ্ধি ও আর্থিক বৃদ্ধির নিরিখে।
এ দফায় সুদ যে অন্তত ২৫ বেসিস পয়েন্ট কমবে, সেটা সবাই ধরে নিয়েছিলেন। কেউ কেউ বলছিলেন কিছুটা বেশি। কিন্তু বাস্তবে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক যে চমক দিয়েছে, সেটা অনেকেই আশা করেননি। ফলে ঋণনীতি ঘোষণার পরে এক লাফে অনেকটা বেড়ে যায় শেয়ার বাজার। যে দৌড়ে নেতৃত্ব দিয়েছে ব্যাঙ্ক, এনবিএফসি, গাড়ি, মোটরবাইক এবং আবাসন ক্ষেত্রের শেয়ারগুলি। দিনের শেষে ৭৪৭ পয়েন্ট বেড়ে সেনসেক্স ৮২,১৮৯ অঙ্কে থেমেছে। ২৫২ পয়েন্ট বেড়ে নিফ্টি ফের পার করেছে ২৫ হাজারের সীমা (২৫,০০৩)। ৮১৮ পয়েন্ট বেড়ে ব্যাঙ্ক নিফ্টি রেকর্ড উচ্চতায় (৫৬,৫৭৮) পৌঁছেছে।
মাত্র চার মাসে রেপো রেট ১০০ বেসিস পয়েন্ট নেমে আসা এবং আগামী দিনে সিআরআর ১০০ বেসিস পয়েন্ট কমার যে সব প্রভাব অর্থনীতিতে পড়তে পারে—
- সুদ কমায় গাড়ি এবং বাড়ির ঋণের কিস্তি বেশ খানিকটা করে কমবে। ফলে বাড়বে এই দুই ঋণের চাহিদা। উচ্চ শিক্ষা ঋণে সুদ কমায় উপকৃত হবেন পড়ুয়ারা।
- বাড়ি, গাড়ি এবং তাদের সহায়ক শিল্পে চাহিদা বাড়বে। ফলে এগোবে একগুচ্ছ শিল্প। বাড়বে কর্মসংস্থান।
- শিল্প ঋণে সুদের চাপ কমবে। চাঙ্গা হবে শিল্প। নিয়ন্ত্রণে থাকবে পণ্যমূল্য।
- জাতীয় অর্থনীতির চাকা সচল থাকবে। ফলে তেজি থাকবে বাজার।
- সুদ কমার কারণে ঋণপত্রের ইল্ড নেমে আসবে। খোলা বাজারে বাড়বে ঋণপত্রের দাম। সরকারের নতুন ঋণে সুদের চাপ কমবে।
- শেয়ার এবং ঋণপত্রের বাজার চাঙ্গা থাকলে তার সদর্থক প্রভাব পড়বে মিউচুয়াল ফান্ডে। ব্যাঙ্ক জমায় সুদ কমলে অনেক মানুষ লগ্নির একাংশ শেয়ার এবং ফান্ডে সরাতে পারেন।
- ব্যাঙ্ক এবং ডাকঘর-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে মেয়াদি আমানতে সুদ কমার আবহ তৈরি হবে। সিআরআর কমে এলে ব্যাঙ্কগুলির হাতে আসবে বাড়তি ২.৫ লক্ষ কোটি টাকার নগদ। তখন ঋণের তহবিল সংগ্রহের জন্য তাদের আর উঁচু হারে সুদ দিতে হবে না।
- ব্যাঙ্ক জমায় সুদ এরই মধ্যে কিছুটা করে কমেছে। তা আরও খানিকটা কমলে বিপাকে পড়বেন সুদ নির্ভর বহু অবসরপ্রাপ্ত মানুষ। বিশেষ করে যাঁরা পেনশন পান না। সুদ কমার কারণে মূল্যবৃদ্ধির হার কমলে অবশ্য কিছুটা সুরাহা হতে পারে তাঁদের।
- জুলাইয়ে বিভিন্ন স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্পের সুদ কমতে পারে। জাতীয় সঞ্চয় প্রকল্পে সুদ কমলে একই হারে সুদ কমানো হতে পারে ভারত সরকারের (আরবিআই) ফ্লোটিং রেট বন্ডে। অর্থাৎ, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ২০২৫ সালে যে পথে হাঁটতে শুরু করেছে তাতে শিল্প, ব্যবসা, শেয়ার বাজার এবং সাধারণ মানুষের একাংশ উপকৃত হলেও চাপে পড়বে অসংখ্য সুদ নির্ভর মানুষ। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যাঁদের ব্যাঙ্ক এবং ডাকঘরে ৩০ লক্ষ টাকা জমা আছে, ১% সুদ কমলে নবীকরণের সময়ে তাঁদের বাৎসরিক আয় কমবে ৩০,০০০ টাকা। অর্থাৎ, মাসে ২৫০০ টাকা।
(মতামত ব্যক্তিগত)