বিপন্ন বাস্তুতন্ত্র
ইউনাইটেড স্টেটস জিয়োলজিক্যাল সার্ভে-র ক্রিটিক্যাল মিনারেল-এর চূড়ান্ত তালিকায় ২০২২ সালে জায়গা করে নিয়েছিল নিকেল। নিকেল বিদ্যুৎচালিত যানবাহনের ব্যাটারির এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ক্রমবর্ধমান বায়ুদূষণের সাপেক্ষে আগামী দিনে বিশ্বব্যাপী নিকেলের চাহিদা যে তুঙ্গে উঠবে, তা সহজবোধ্য। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি নিকেল মজুত রয়েছে ইন্দোনেশিয়ায়। স্বাভাবিক ভাবেই সাম্প্রতিক বছরগুলিতে এই দেশকে ঘিরে খনি-সংস্থাগুলির কর্মব্যস্ততা তুঙ্গে উঠেছে। কিন্তু এর ভয়ঙ্কর প্রভাব পড়ছে দ্বীপময় দেশটির পরিবেশের উপর। নির্বিচারে চলছে অরণ্যছেদন, প্রবল জলদূষণের সম্মুখীন হচ্ছে জীববৈচিত্র সমৃদ্ধ রাজা আম্পত দ্বীপপুঞ্জ।
এই পরিণতি বিরল মৃত্তিকা উপাদানগুলির ক্ষেত্রেও সত্য। এই খনিজগুলি দুষ্প্রাপ্য নয়, কিন্তু জোগান-শৃঙ্খলটি নড়বড়ে, তদুপরি চাহিদার সঙ্গে উৎপাদন তাল মেলাতে অক্ষম। মাত্র কয়েকটি দেশ এগুলি উৎপাদন ও রফতানি করে, যাদের মধ্যে চিন সর্বাগ্রগণ্য। বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ খনিজগুলির ৬০ শতাংশই চিন উৎপাদন করে। ৯০ শতাংশের প্রক্রিয়াকরণও তার দখলে। এই কর্তৃত্ব স্থাপনই সাম্প্রতিক ভূরাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক দ্বন্দ্বের পরিপ্রেক্ষিতে অত্যাবশ্যক খনিজ মানচিত্রে চিনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাটি পরিস্ফুট করেছে। এবং এইখানেই আমেরিকার সঙ্গে তার বিরোধের বীজটিও লুকিয়ে। সম্প্রতি ডোনাল্ড ট্রাম্প চিনা পণ্যের উপর ১৪৫ শতাংশ শুল্ক চাপানোর প্রতিবাদস্বরূপ চিন বিরল মৃত্তিকা উপাদান রফতানির উপর বিধিনিষেধ চাপিয়েছে। ফলে প্রবল বিপদের মুখে বিশ্বের গাড়িশিল্প। লক্ষণীয়, আমেরিকায় গুরুত্বপূর্ণ খনিজের জোগান প্রায় সম্পূর্ণতই আমদানি-নির্ভর। সুতরাং, অতিরিক্ত চিন-নির্ভরতা এড়িয়ে তারা বিকল্প পথের চিন্তা শুরু করে দিয়েছিল আগে থেকেই। এক দিকে তারা স্ব-দেশে গুরুত্বপূর্ণ খনিজের খনন এবং প্রক্রিয়াকরণের উপর জোর দিয়েছে, অন্য দিকে কানাডা, ভারত-সহ পনেরোটি দেশ মিলে গড়ে তুলেছে ‘মিনারেলস সিকিয়োরিটি পার্টনারশিপ’, যাতে জোগান-শৃঙ্খলটি অব্যাহত থাকে।
পাশাপাশি, আমেরিকা দ্বিপাক্ষিক চুক্তির পথেও হাঁটতে চাইছে। উজ়বেকিস্তানের বিপুল খনিজ ভান্ডারের দিকে নজর রয়েছে তার। তালিকায় রয়েছে পশ্চিম এশিয়ার অন্য দেশগুলিও। কিন্তু, এই দিকে নজর রয়েছে চিন, এমনকি রাশিয়ারও। ফলে বিনা যুদ্ধে আমেরিকাকে জমি ছাড়বে না কেউই। নিঃসন্দেহে বলা যায়, আগামী দিনে ভূ-রাজনীতি এবং শক্তির ভারসাম্য অনেকটাই নির্ধারিত হবে গুরুত্বপূর্ণ খনিজের বাজারটিতে আধিপত্য বিস্তারের মাপকাঠিতে। কিন্তু বেপরোয়া খনিজ উত্তোলনে বিপদ ঘনাবে পরিবেশের। ধ্বংস হবে বনজসম্পদ, বন্যপ্রাণ। মানবাধিকার লঙ্ঘিত হবে নির্বিচারে। চিলিতে লিথিয়াম উত্তোলন যেমন পরিস্রুত জলের সরবরাহ ব্যাহত করেছে, ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অব দ্য কঙ্গোয় কোবাল্ট ও তামা নিষ্কাশনের ফলে শিশুশ্রম, জবরদস্তি উচ্ছেদের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে, ইন্দোনেশিয়াতে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র। অবশ্য ইন্দোনেশিয়া সরকার বিপদ বুঝে প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় এগিয়ে এসেছে। কিন্তু দুই মহাশক্তিধর দেশের প্রতিযোগিতার সামনে সেই প্রতিরোধ বালির বাঁধ। আগামী দিনে পরিবেশরক্ষার উপাদানগুলিই পরিবেশ ধ্বংসের কারণ হয়ে উঠবে কি না, সেই প্রশ্নই ভাবাবে বিশেষজ্ঞদের।