তখন সন্ধ্যা গড়িয়েছে বিজয়া দশমীর। জনৈক স্নেহভাজন এসে প্রণামের চেষ্টা করতেই বাগবাজার সর্বজনীনের প্রবীণ কর্তা অভয় ভট্টাচার্য আঁতকে সরে গেলেন। ‘‘আমার শুভেচ্ছা, আশীর্বাদ সব তোমায় দিয়ে দিচ্ছি, বাবা। কিন্তু আমাদের ঠাকুর জলে পড়েনি। এখন প্রণামটা নিতে পারব না।’’
দশমীর তিথি পড়ায় সকালেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টির আবহে দর্পণ বিসর্জন, মেয়েদের ঠাকুর বরণ, সিঁদুর মাখামাখি হয়ে গিয়েছে। কিন্তু বিসর্জন হতে কোথাও কোথাও দেরি হয়। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় অভয়ের স্নেহাস্পদ যখন প্রণাম করতে যাচ্ছেন, বাগবাজারের ডাকের সাজের চিরন্তনী সবে ট্রেলারে উঠছেন। অভয় বলে দিলেন, ‘‘উঁহু প্রণাম এখন নেওয়া যাবে না।’’ আজকের যুগ ধর্মে কলকাতার এই ত্রিকালদর্শী পুজোকর্তা ব্যতিক্রমী। কারণ নবমীর রাত থেকেই ইদানীং শুভ বিজয়া সম্ভাষণ শুরুর দস্তুর। হাওয়া অফিসের নিম্নচাপের পূর্বাভাস ফলে যাওয়ায় বাঙালির উৎসব শেষের বিষাদের সঙ্গে মানানসই পরিবেশ রচনা করে প্রকৃতি। বিজয়া দশমীর দুপুরেই ঝেঁপে বৃষ্টি আসায় কলকাতার আকাশে যেন সন্ধ্যা নেমে এসেছিল। উত্তর কলকাতার বড় পুজোর প্যান্ডেল বৃষ্টিতে ধূসর। শুধু জ্বলছে বিজ্ঞাপনী এলইডি প্যানেলের আলো। ঢাকিরা বৃষ্টিতে রণে ভঙ্গ দিয়ে একটি ছাউনির নীচে শরণার্থী। কিন্তু আবহে বাজছে ঢাকের বাদ্যি।
দুপুরের বৃষ্টি কাঁপিয়েছে কলকাতা, দুই ২৪ পরগনা, হুগলি, পূর্ব বর্ধমান থেকে দক্ষিণবঙ্গের বিস্তীর্ণ অংশে। ফলে সন্ধ্যায় ঠাকুর দেখার হিড়িক কিছুটা কম ছিল। কলকাতার টালা প্রত্যয়, নলিন সরকার স্ট্রিট বা ত্রিধারা, সুরুচি সঙ্ঘ, বালিগঞ্জ কালচারাল, বেহালা ফ্রেন্ডসদের প্রতিমা, মণ্ডপ দেখতে ঔৎসুক্যে সামান্য ভাটা পড়ে দশমীর সন্ধ্যায়। কলকাতার দর্শক টানা কল্যাণীর লুমিনাস ক্লাব, রথতলা সর্বজনীন, নাইন-এ স্কোয়ার, সেন্ট্রাল পার্কেও কয়েক দিনের তুলনায় ভিড় কম। বহরমপুরের বড় পুজোর মণ্ডপেও ভিড় কমেছে। পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রামে বৃষ্টির সঙ্গে ছিল ঝোড়ো হাওয়া। সন্ধ্যায় বৃষ্টি কমলে সেখানে ভিড় জমেছে। পুরুলিয়া শহর, নিতুড়িয়া, ঝালদায় ঝিরঝিরে বৃষ্টিতেও লোকে ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছেন। মালদহ শহরের বড় পুজো মণ্ডপগুলিতেও ভিড় ছিল।
বিজয়া দশমীতে প্রধানত বড়বাড়ি বা পুরনো রীতি মেনে চলা কয়েকটি সাবেকি পুজোর বিসর্জন হয়। তবে কলকাতার কার্নিভালগামী কয়েকটি পুজো ঘট বিসর্জন সেরে ফেলেছে। আবার বিজয়া দশমীর এই দুপুরেই মেয়র ফিরহাদ হাকিমের সঙ্গে একটি বৈঠকে ঠাকুরপুকুর এসবি পার্ক সর্বজনীনের পুজোকর্তা সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের কাছে একটি বিশেষ অনুরোধ গিয়েছে। মেয়র চান, এসবি পার্কের বড় পুরস্কারজয়ী প্রতিমাটি যেন সংরক্ষণের জন্য দেওয়া হয়। ঠিক হয়েছে, শিল্পী রাজু সরকারের তৈরি প্রতিমা রবিবারের কার্নিভাল অনুষ্ঠানের পরেই ভাসান না-দিয়ে মণ্ডপে ফিরে যাবে। পরে তা রবীন্দ্রসরোবরে কলকাতা পুরসভার সংগ্রহশালায় ঠাঁই পাবে।
বৃষ্টির জেরে কয়েকটি নিরঞ্জন এ দিন স্থগিত রাখা হয়। শোভাবাজার রাজবাড়ির প্রতিমা বাগবাজার ঘাটের গঙ্গায় বা কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির প্রতিমা জলঙ্গিতে বিসর্জন দেওয়া হয়। গজাশিমূলে রাবণ পোড়া উৎসব বৃষ্টিতে স্থগিত হয়ে যায়। লালগড় ও গড় শালবনিতে অবশ্য রাবণ দহন হয়েছে। বীরভূমের দুবরাজপুরে যথারীতি দোলা বিসর্জন হয়েছে, তবে বৃষ্টির কারণে চেনা ভিড় ছিল না। বোলপুর, রামপুরহাট ও সিউড়ির রাস্তায় সন্ধ্যায় ভিড় বেড়েছে। পশ্চিম মেদিনীপুরের খড়্গপুর শহরের রাবণ দহন দেখতেও ভিড় ছিল। চন্দ্রকোনা রোডের নয়া বসতে রাবণ দহন ছিল ভিড়ে-ভিড়াক্কার। 
এ দিন বেলা ১২টা থেকেই শিলিগুড়িতে প্রতিমা নিরঞ্জন শুরু হয়েছিল। বৃষ্টি উপেক্ষা করেই প্রতিমা ভাসান দেয় দক্ষিণ দিনাজপুরের বেশির ভাগ ক্লাব। কোচবিহারে তোর্সা নদীর একাধিক ঘাটে বিসর্জন হয়। নদিয়ার রানাঘাটে চূর্ণী নদীতে, চাকদহে ভাগীরথীতে ভালই বিসর্জন হয়েছে। পূর্ব বর্ধমানের কাটোয়ায় ভাগীরথীর কাশীগঞ্জ ও দেবরাজ ঘাটে বিসর্জন দেখতে অনেকেই হাজির হয়েছিলেন। বহরমপুরের কৃষ্ণনাথ কলেজ ঘাটে আবার ভিড় প্রায় 
ছিলই না।