হাতে ও ভাতে
বিজেপি শাসনের ভারতে, বিশেষত উত্তর ভারতে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি মুসলমান-বিদ্বেষে বহুদিনই রাখঢাকহীন। যে সংগঠনের অস্তিত্বের ভিত্তিই হল পরধর্মবিদ্বেষ, তার মতাদর্শ নিয়ে কথা চলে না— তাদের কাজকর্ম কোন কোন ক্ষেত্রে বেআইনি, অসাংবিধানিক, আইনের শাসন লঙ্ঘনকারী এবং সমাজের পক্ষে বিপজ্জনক, কথা হওয়া দরকার সেই নিয়ে। ছটপূজার আবহে যেমন দিল্লিতে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ঘোষণা করেছে, প্রতিটি জেলায় তারা স্টল দেবে, যেখান থেকে পূজার ‘পবিত্র, বিশুদ্ধ’ সামগ্রী পাওয়া যাবে। এ ছাড়া যে হিন্দু দোকানদার, ফেরিওয়ালা, বিক্রেতা বা ছোট ব্যবসায়ীরা পূজার সামগ্রী বিক্রি করেন তাঁদের দোকানে-স্টলে ‘সনাতন প্রতিষ্ঠা’ স্টিকার সাঁটানো হবে। ছটপূজার সঙ্গে সনাতন প্রতিষ্ঠার সম্পর্ক কী সেই উত্তর চেয়ে লাভ নেই, কারণ উত্তরটি জানা: যে দোকান-স্টলে স্টিকার সাঁটা থাকবে না সেগুলি বিধর্মীর, সংখ্যালঘুর দোকান। স্টিকার সাঁটার আসল উদ্দেশ্য পাড়ায় পাড়ায় মুসলমান দোকানি-ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করা, এবং ঘুরিয়ে কিংবা প্রকাশ্যে এই নিদান যে, তাঁদের কাছ থেকে কেউ যেন পূজার সামগ্রী না কেনেন। নাৎসি জার্মানিতে ইহুদিদের দোকান-বাড়ি ইত্যাদির গায়ে হলুদ তারাচিহ্ন সাঁটা হত, মনে পড়তে পারে।
হাতে না মারতে পেরে ভাতে মারার উদাহরণ ইতিহাসে ভূরি ভূরি। ভারতে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি এই দু’টি উপায়েই মুসলমান-পীড়নের ‘বিশিষ্টতা’ অর্জন করেছে; এখানে সংখ্যালঘু নাম-পরিচয় মানেই নির্যাতিত হওয়ার পথ প্রশস্ত, ফ্রিজে গোমাংস আছে এই গুজবটুকুই কাউকে পিটিয়ে মেরে ফেলার জন্য যথেষ্ট যুক্তি, মুসলমানদের ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান বলতে বাধ্য করায় তো দেড়ে আনন্দ। এই সব কিছুর সঙ্গেই ইদানীং যুক্ত হয়েছে সংখ্যালঘু দোকানি ও ছোট ব্যবসায়ীদের একঘরে করে তোলার বিবিধ বিচিত্র কৌশল। ছটপূজার দিল্লিতে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নিদান কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বছর তিন আগে দিল্লিতেই এক বিজেপি সাংসদ মুসলমানদের থেকে জিনিসপত্র কেনা ‘সম্পূর্ণ বয়কট’-এর কথা বলেছিলেন, দু’বছর আগে হরিয়ানায় বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বজরং দল মিলে সংখ্যালঘু ব্যবসায়ীদের আর্থিক ভাবে একঘরে করা ও গ্রাম থেকে মুসলমান-বিতাড়নে উঠেপড়ে লেগেছিল। গত বছর হিমাচল প্রদেশেও ঘটে একই বয়কটের ঘোষণা, সঙ্গে সংখ্যালঘুদের চাকরি বা বাড়ি ভাড়া দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রচার। এ বছর জুলাইয়ে কাঁওয়ার যাত্রার সময়ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদ দিল্লির পাঁচ হাজার দোকানে ‘সনাতনী’ স্টিকার সেঁটে দেয়; সে সময় উত্তরপ্রদেশ ও উত্তরাখণ্ড রাজ্য সরকার পথের পাশে ধাবা-রেস্তরাঁগুলির মালিক ও কর্মীদের নাম প্রদর্শনের যে নির্দেশ দিয়েছিল, শীর্ষ আদালতের হস্তক্ষেপে তা বন্ধ হয়েছিল।
হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি যে তার পরেও এতটুকু দমেনি, প্রমাণ ছটপূজার দিল্লি। এই স্পর্ধার কারণও অজানা নয়: শাসকের কল্যাণহস্ত, প্রশাসন ও পুলিশের প্রচ্ছন্ন ও প্রকাশ্য সমর্থন না থাকলে নীতি-নৈতিকতা, মানবিকতা ও সর্বোপরি আইন উড়িয়ে এ সব কাজ করা যায় না। ধর্মীয় উৎসবের আবহে এই গর্হিত অপরাধগুলি আজকের ভারতে হতেই থাকবে, অনুমান করা চলে। আদালত একটা বড় ভরসার জায়গা অবশ্যই, কিন্তু সমাজে যে ক্ষত ক্রমাগত বিষিয়ে উঠছে, তার কী হবে?