নির্ঘণ্ট মেনেই সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিনে নির্বাচন কমিশন প্রকাশ করল বিহারের চূড়ান্ত ভোটার তালিকা। একই সঙ্গে সাঙ্গ হল কোনও রাজ্যে ভোটার তালিকায় সর্বকালের সর্বাধিক বিতর্কিত স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন (এসআইআর) বা বিশেষ নিবিড় সংশোধন প্রক্রিয়া। এরই মধ্যে বিহার তৈরি দুই দফার ভোটের জন্য।
জুনের ২৪ তারিখ হঠাৎই নির্বাচন কমিশন এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায় যে, দেশে পর্যায়ক্রমে প্রতিটি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের নির্বাচক তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন হবে। তবে বিহারে যে হেতু এই বছরের শেষের দিকেই বিধানসভার নির্বাচন হচ্ছে, তাই ওখানেই প্রথম এসআইআর সেরে ফেলতে হবে। কমিশন জানায় যে, শেষ বার বিহারে নিবিড় সংশোধন হয়েছিল ২০০৩-এ। তাই, এ বারের এসআইআর-এ রাজ্যের সেই ২০০৩-এর ভোটার তালিকাই হবে ভিত্তি-নথি। অর্থাৎ, যাঁদের নাম ভিত্তি-নথিতে আছে, তাঁদের কোনও সমস্যা নেই। আর যাঁদের নাম ২০০৩-এর তালিকায় পাওয়া গেল না, তাঁরা কমিশন-নির্দেশিত এগারোটি নথির তালিকা থেকে যে কোনও একটি দাখিল করেই নাম তুলতে পারবেন। তবে ৬ নম্বর প্রপত্র (ফর্ম) পূরণ করতে হবে; সঙ্গে একটি অতিরিক্ত মুচলেকা দিতে হবে।
সেই অনুযায়ী পর দিন, অর্থাৎ ২৫ জুন থেকেই বুথ লেভেল অফিসার (বিএলও)-রা বাড়ি বাড়ি গিয়ে এনুমারেশন ফর্ম বিলির কাজ শুরু করে দেন। এই বিশেষ শুমারিপত্রটি রাজ্যের প্রত্যেক ভোটারই পূরণ করে প্রয়োজনীয় নথি-সহ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিএলও-র কাছেই জমা দেবেন।
স্থির হয় যে, পুরো নিবিড় সংশোধন প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হবে ৯৮ দিনে। অর্থাৎ, রাজ্যের ৭.৮৯ কোটি ভোটারের নির্বাচক তালিকায় নিবিড় সংশোধনের জন্য সময় একশো দিনেরও কম। কমিশনের এমন ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্তের পিছনে যে কেন্দ্রের ভূমিকা আছে, তা অনুমান করা চলে। ১৯৫২ থেকে ২০০৪ অবধি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল মিলিয়ে ভারতে বহু বার ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধন হয়েছে। তবে প্রতিটি ক্ষেত্রেই পর্যাপ্ত সময় নিয়ে প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়েছে। নির্বাচন কমিশন ‘ইলেকশন ইয়ার’ বলে একটি পরিভাষা ব্যবহার করে— যার অর্থ, লোকসভা বা বিধানসভা নির্বাচন-পূর্ব ছ’মাস সময়কাল। ওই ছ’মাসে এসআইআর-এর মতো কোনও বৃহৎ কর্মসূচি কমিশন সাধারণত হাতে নেয় না। বিহারের বেলায় কিন্তু ‘ইলেকশন ইয়ার’-এর ভিতরেই তড়িঘড়ি করে এসআইআর হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে। কিন্তু কোনও যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা কমিশন দিতে পারেনি।
এ বার উল্টো পিঠটা দেখা যাক। ইন্ডিয়া জোট, এবং নির্দিষ্ট ভাবে তৃণমূল কংগ্রেস প্রথম থেকেই পুরো প্রক্রিয়াটিরই বিরোধিতা করেছে। রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে কমিশন এবং বিজেপিকে কোণঠাসা করার চেষ্টা চলে এবং এখনও চলছে। সেটাই স্বাভাবিক বিরোধী প্রতিক্রিয়া। কিন্তু মুশকিল দেখা দিল, যখন এরা অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্র্যাটিক রিফর্মস (এডিআর)-এর সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে আইনি লড়াইতে নেমে পড়ল। বিরোধীদের প্রথম দাবি ছিল এসআইআর বন্ধ করতে হবে, কারণ এই প্রক্রিয়া অসাংবিধানিক। সুপ্রিম কোর্ট প্রত্যাশিত ভাবেই এই আবেদন নাকচ করে দেয়।
সংবিধানের পঞ্চদশ অধ্যায়ে বর্ণিত বিষয় হচ্ছে নির্বাচন। ৩২৪ থেকে ৩২৯— মোট ছ’টি অনুচ্ছেদ রয়েছে সেখানে। নির্বাচন প্রক্রিয়া এবং নির্বাচন-সংক্রান্ত যে কোনও বিষয়ে কমিশনই যে যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকারী, তা ৩২৪ নম্বর অনুচ্ছেদে বর্ণিত রয়েছে। ১৯৫০-এর ২৬ জানুয়ারি ভারতের সংবিধান কার্যকর হয়। এর ঠিক আগের দিন— ১৯৫০ সালের ২৫ জানুয়ারি— গঠিত হয় নির্বাচন কমিশন। আর ওই বছরের মে মাসেই ‘দ্য রিপ্রেজ়েন্টেশন অব দ্য পিপল অ্যাক্ট, ১৯৫০’ সংসদে পাশ হয়ে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন-সহ কার্যকর হয়ে যায়। ভোটার তালিকা কী ভাবে তৈরি হবে, কী প্রক্রিয়াতে বিভিন্ন সময়ে বিশেষ সংশোধন এবং নিবিড় পরিমার্জন হবে, এই সমস্ত বিষয় ১৯৫০ সালের আইনে বিস্তারিত ভাবে বর্ণনা করা হয়। প্রথম মুখ্য নির্বাচন কমিশনার সুকুমার সেনকেও কমিশনে তাঁর আট বছরের কর্মজীবনে ওই আইন মেনেই চলতে হয়েছিল। এক দশক পর এই আইনের পরিপূরক বিধি ‘রেজিস্ট্রেশন অব ইলেক্টরস রুলস’ (আরইআর, ১৯৬০) প্রণীত হয়। এই আইন এবং সংশ্লিষ্ট বিধির ২১ নম্বর ধারা অনুযায়ী ভোটার তালিকায় এসআইআর-এর ক্ষমতা শুধু কমিশনের হাতেই রয়েছে। লক্ষণীয়, কমিশন চাইলে শুধুমাত্র একটি বিধানসভা কেন্দ্রের জন্যেও এসআইআর করাতে পারে।
এখানেই শেষ নয়। বিরোধীরা এটাও বলেছেন যে, কমিশন কেন স্থির করবে কে ভারতীয় নাগরিক, আর কে নয়। সংবিধানের ৩২৬ নম্বর অনুচ্ছেদ এবং ১৯৫০-এর জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের ১৬ ও ১৯ নম্বর ধারা অনুযায়ী ভোটার তালিকায় নাম তুলতে চারটি শর্ত পূরণ করতে হয়। এর প্রথমটিই হচ্ছে আবেদনকারীকে ভারতীয় নাগরিক হতে হবে। অর্থাৎ আবেদনকারীর নাগরিকত্ব নির্ধারণে কমিশনের পূর্ণ সাংবিধানিক ও আইনি এক্তিয়ার রয়েছে। এ ক্ষেত্রেও কমিশন সঠিক ভাবে নাগরিকত্ব আইন, ১৯৫৫-র ৩ নম্বর ধারা ব্যবহার করছে।
গোটা প্রক্রিয়াতে সমস্ত রাজনৈতিক দলকে কেন শামিল করা হল না, এটাও একটি বিরোধী অভিযোগ ছিল। অথচ ২৪ জুনের বিজ্ঞপ্তিতে লেখা রয়েছে, স্বীকৃত রাজনৈতিক দলগুলিকে বলা হবে যে, তারা যেন বিএলএ-দের নিয়োগ করে তালিকাটি কমিশনের কাছে জমা দেয়। এতে বিরোধী দলগুলি তেড়েফুঁড়ে উঠল। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বললেন, “এত আগে কেন বিএলএ-তালিকা দেব?” ২২ অগস্ট সুপ্রিম কোর্টকে বলতে হল, রাজনৈতিক দলগুলো তাদের বিএলএ-দের নির্দেশ দেবে তাঁরা যেন ভোটারদের পাশে থেকে সাহায্য করেন।
সব শেষে আধার প্রসঙ্গ। আধার যে নাগরিকত্ব প্রমাণের নথি নয়, নেহাতই বাসস্থান এবং পরিচয়ের চিহ্নায়ক— এ কথা সর্বজনবিদিত। যে কোনও ব্যক্তি তাঁর আধার কার্ডের উল্টো পিঠে চোখ বুলোলেই দেখবেন যে, লেখা রয়েছে, ‘আধার ইজ় প্রুফ অব আইডেন্টিটি, নট অব সিটিজ়েনশিপ’। অথচ এই জানা বিষয়টি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দরজায় কড়া নাড়তে হল! ৮ সেপ্টেম্বর শীর্ষ আদালত ওই জানা কথাটিই ফের জানাল। বিরোধীরা এবং দেশের অগ্রণী সংবাদমাধ্যম তাতেই বেজায় খুশি।
ইন্ডিয়া জোট বারংবার আদালতে গিয়ে হাতে কিন্তু পায়নি কিছুই। মাঝখান থেকে জনগণের চোখে বিরোধীদের আন্দোলন দুর্বল হয়েছে। রাজনীতির ময়দানে বাস্তব যতখানি গুরুত্বপূর্ণ, সেই বাস্তব সম্বন্ধে মানুষের ধারণার গুরুত্ব তার চেয়ে কিছু কম নয়। এখানেই মার খেয়েছেন বিরোধীরা। প্রশ্নটি ছিল সম্পূর্ণ রাজনৈতিক এবং যথাযথ— কমিশন কেন ‘ইলেকশন ইয়ার’-এ এসআইআর করল, এটাই হচ্ছে মৌলিক প্রশ্ন। এখানে যে শাসক দলের হাত রয়েছে, তা আন্দোলনের মাধ্যমেই জনগণকে বোঝানোর দরকার ছিল। সেই সুযোগ এখনও থাকছে। গত লোকসভা নির্বাচন থেকে নানা কারণে কমিশন একটু একটু করে বিশ্বাসযোগ্যতা খুইয়েছে। এই যে খসড়া তালিকায় ৬৫ লক্ষ ভোটারের নাম কাটা গিয়েছিল তা ছিল অবিশ্বাস্য। বিহারের মোট ভোটারসংখ্যার নিরিখে ৮.২৪ শতাংশ। এ বার এই হার যদি দেশের গড় হয়, তা হলে তো গোটা দেশে আট কোটি ভোটার তালিকা থেকে বাদ যাবেন!
চূড়ান্ত তালিকায় কাটছাঁটের হিসেব কমিশন দিয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, সব মিলিয়ে ৬৮.৬ লক্ষ ভোটারের নাম মূল তালিকা থেকে বাদ গেছে। প্রথম দফায় বাদ গিয়েছিল ৬৫ লক্ষ। ‘অযোগ্য ভোটার’ দেগে দিয়ে দ্বিতীয় দফায় বাদ যায় আরও ৩.৬৬ লক্ষ প্রাপ্তবয়স্কের নাম। নতুন করে নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য পুরো সেপ্টেম্বর মাসটা ছিল। ওই সময়সীমায় ২১.৫৩ লক্ষ ‘যোগ্য’ ভোটারের নাম নতুন করে অন্তর্ভুক্ত হয়। কমিশনের দাবি, তাদের আপ্তবাক্যই হচ্ছে ‘যোগ্য ভোটার বাদ পড়বে না, অযোগ্য ভোটার তালিকায় থাকবে না’। এই নীতি মেনেই নাকি বিহারে এসআইআর হয়েছে।
রাহুল গান্ধীদের উচিত ছিল এই বিষয়টিকে জনতার দরবারে নিয়ে যাওয়া। তা না করে বলা হল যে, কংগ্রেস নাকি ৮৯ লক্ষ ওজর-আপত্তি কমিশনের কাছে জমা করেছে। কমিশন গা করেনি। উল্টে বলেছে, আইনি পদ্ধতি মেনে আবেদন জমা পড়েনি। নাম তোলা বা কোনও নামের অন্তর্ভুক্তির বিরুদ্ধে আবেদন করার জন্য নির্দিষ্ট ৭ নম্বর ফর্ম পূরণ করে নির্দিষ্ট ভোট কেন্দ্রের বিএলও-র কাছেই জমা করতে হয়। এটাই দস্তুর। কংগ্রেস সেটা নিশ্চিত ভাবেই করে উঠতে পারেনি। এর জন্য যে হোমওয়ার্ক, আইনকানুন সম্পর্কে সম্পূর্ণ জ্ঞান এবং জোরদার সাংগঠনিক শক্তি প্রয়োজন, এর কোনওটাই কোনও বিরোধী দলের আছে বলে মনে হয় না। কংগ্রেস তো নয়ই। পরিশ্রম এড়াতে তাই ঘনঘন আদালতে। আখেরে লাভ হচ্ছে আরএসএস ও বিজেপির। নিজেদের বিপুল আলস্য আর হোমওয়ার্কের অভাবে বিরোধীরা এত সমস্যাপূর্ণ এসআইআর থেকেও রাজনৈতিক লাভ অর্জনের সুযোগ হারাল।