তিনিই যে বাংলার মুখ
সায়নদেব চৌধুরী লিখিত ‘তোমার পূজার ছলে’ (২১-৯) মূল্যবান প্রসঙ্গের অবতারণা করল। ৫৩ বছর বয়সে উত্তমকুমারের চলে যাওয়াটাও এতই আকস্মিক যে অশীতিপর গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস-এর মতো তাঁর এ-কথা বলারও অবকাশ ছিল না যে, গভীর বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হচ্ছি কিন্তু তবু, বিষণ্ণতায় আপন্ন না হলে কি শিল্প সৃষ্টি করা যায়? ‘ব্যাগি ট্রাউজ়ার্স পরিহিত’ এক মানবমিত্র বলেছিলেন, “ক্লোজ়-আপ-এ দেখলে জীবন ট্র্যাজেডি, কিন্তু লং-শট থেকে জীবন কমেডি”— বিশ্ব চলচ্চিত্রের আসর তাঁকে বলেছে ‘ট্র্যাজেডি কিং’– তিনি চার্লি চ্যাপলিন।
চলচ্চিত্র একটি দৃশ্যশ্রাব্য শিল্পমাধ্যম। কিন্তু কী দেখব আর কী শুনব, সে বিষয়টা ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে ভিন্ন। তা আবার ব্যক্তির আবাল্যলালিত নানা বিধিবিধানের তারতম্যে প্রভাবিত হয়— অর্থাৎ বহু ক্ষেত্রেই আমাদের দেখতে বা শুনতে দেওয়া হয় না, দেখতে বা শুনতে শেখানো হয়। এই শেখানোর উপরে নির্ভর করে শিল্প ও শিল্পী গৃহীত বা বর্জিত হন। উত্তমকুমার কি সর্বজনগৃহীত হয়েছিলেন, না কি বর্জিত হওয়ার শ্রান্তিও তাঁকে আপন্ন করেছিল? কেন গৃহীত হলেন, আবার বর্জিত হলেও বা কেন হলেন, এই আলোচনাই তাঁর জন্মশতবর্ষে আলোচ্য হওয়া দরকার। মৃত্যুর ৪৫ বছর পরে আমরা কি তাঁকে মরণোত্তর মৃত্যু উপহার দেব, না কি প্রকৃত উত্তমালোকে স্নাত হয়ে অসামান্য এই শিল্পীর জীবনসাধনা উপলব্ধি করে মৃতপ্রায় বাংলা চলচ্চিত্রে মৃতসঞ্জীবনীর সন্ধান করব? ৫৩ বছর বয়সে কেউ কি লং-শট থেকে জীবন দেখতে পায়? সাধারণ মানুষ না দেখতে পেলেও শিল্পীরা হয়তো পান— উত্তমকুমার নিশ্চয়ই দেখতে পেয়েছিলেন। পেয়েছিলেন বলেই হয়তো তথাকথিত স্বঘোষিত বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের চলচ্চিত্রবেত্তাদের চোখে যথাযথ মূল্য না পাওয়ার পরেও, তিনি খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের ম্যাটিনি আইডল। মানুষ তাঁর ছবিতে নিজেদের কান্না, ঘাম, স্বপ্ন, ভালবাসা দেখতে পেয়েছিলেন। বাংলা চলচ্চিত্রের কালপুরুষ সত্যজিৎ তাঁর নায়ক-এ আর দ্বিতীয় কোনও মুখ দেখতে পাননি এ কথা বহুশ্রুত।
তা হলে কি আমরা বলতে পারি যে ৫৩-তে প্রয়াত শিল্পীও তাঁর নিভৃতে বলেছিলেন, “গভীর বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হচ্ছি?” শিল্পীর বিষণ্ণতা ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়, শিল্পীর মননে ধরা পড়া তাঁর সময়ের বিষণ্ণতা তাঁকে আক্রান্ত করে— সেই সুর শাহরিক শাপমোচনে চলচ্চিত্রায়িত হয়েছিল প্রায় অভিব্যক্তিহীন বিপন্ন নিষ্পলক যে দৃষ্টির মাধ্যমে, তার দৃশ্যায়ন হয়তো একান্তই উত্তম-সুলভ। যে বিষণ্ণতা, যে বিপন্নতা মেলোড্রামা না হয়েও অভিব্যক্ত অসংখ্য ছবিতে। আমরা কি সত্যিই নজর করে দেখেছি এই বঙ্গে উত্তর-ঔপনিবেশিক কালে মানবীয় বিপন্নতার স্মারক তাঁর অসংখ্য অভিব্যক্তি কী ভাবে মধ্যবিত্ত ও খেটে খাওয়া ‘বাংলার মুখ’ হয়ে উঠেছিল?
উত্তমকুমার ‘ম্যাটিনি আইডল’ হিসাবে গৃহীত হয়েছিলেন কারণ তাঁর রূপায়িত পজ়িটিভ বা নেগেটিভ চরিত্রেরা সাধারণ মধ্যবিত্ত ও খেটে খাওয়া মানুষের ব্যক্তিগত ও বিষয়ভিত্তিক অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলে যায়। আমরা হয়তো প্রকৃত বস্তুনিষ্ঠ ভাবে ছবিগুলোর পাতায় পাতায় চোখ মেলে দেখলে দেখতে পাব মানবমনের প্রেম, হর্ষ, বিষাদ, বিপন্নতা, ক্রোধ, মোহ, কামনা, যন্ত্রণা ও স্বপ্ন কী আশ্চর্য শৈল্পিক দক্ষতায় ফুটে উঠেছে তাঁর মুখের রেখায় রেখায়, স্বরক্ষেপণে। সে সব দৃশ্য মন দিয়ে পড়লে অনুভব করব কী আশ্চর্য সাধনায়, মুহূর্তে ‘বাংলার মুখ’ পেরিয়ে গিয়েছে সমস্ত আঞ্চলিকতা, জাতীয় স্তরও পার হয়ে তিনি কখনও কখনও হয়ে উঠেছেন মার্লন ব্র্যান্ডো বা রিচার্ড বার্টন-এর মতো আন্তর্জাতিক।
অনিরুদ্ধ রাহা
কলকাতা–১০