নির্বাচন কমিশনের প্রতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হুঁশিয়ারি ছিল, আগুন নিয়ে খেলবেন না। কেউ তথ্য চাইতে এলেই এক কথায় দিয়ে না-দেওয়ার পরামর্শও দিয়েছিলেন তিনি। রাজ্যে ‘বৈধ’ কোনও ভোটারের নাম বাদ গেলে লক্ষ লোক নিয়ে কমিশন ঘেরাওয়ের ডাক দিয়ে রেখেছিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে বাংলায় ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সংশোধন প্রক্রিয়া (এসআইআর) শুরুর ঘোষণার সঙ্গেই শাসক দলের তরফে ‘হেল্পলাইন’ সক্রিয় করা হচ্ছে। তার পাশাপাশি সিপিএম জানিয়ে দিয়েছে, তাদের দলের বিভিন্ন দফতর থেকে ২০০২ সালের ভোটার তালিকা পাওয়া যাবে এবং মানুষকে সহায়তা করা হবে।
ভোটার তালিকায় প্রতিটি নাম তোলা, রাখা ও বাদ দেওয়ার নির্দিষ্ট তথ্য যাচাইয়ে অঞ্চলভিত্তিক ‘টিম’ তৈরি করছে তৃণমূল কংগ্রেস। গত কয়েক মাস ধরে এসআইআর প্রস্তুতির মধ্যে কম-বেশি ৮০ হাজার বুথের জন্য এই ‘টিম’ তৈরি করেছেন দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেকই। নির্দিষ্ট ফর্ম পূরণ, প্রয়োজনীয় নথি সংগ্রহ, এমনকি প্রয়োজনে ছবি তোলা ইত্যাদি সব কাজের জন্য এলাকা ভিত্তিক শিবির তৈরির প্রস্তুতিও রয়েছে
তৃণমূলের। দলের এক নেতার কথায়, “নির্বাচন সংক্রান্ত নিয়মবিধি মেনেই দল এই ‘হেল্পলাইন’ বা সহায়তা পরিষেবা চালু রাখবে। এবং গোটা প্রক্রিয়া তদারকির জন্য জেলা ও রাজ্য স্তরেও আলাদা ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে। প্রকৃত ভোটার তালিকায় থাকবেনই।” দু’-এক দিনের মধ্যে দলের তরফে আনুষ্ঠানিক ভাবে এই পরিকল্পনা ঘোষণা করা হবে। এই ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট দলীয় নেতা-কর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করছে তৃণমূল।
তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ সোমবার দলের কর্মীদের উদ্দেশে বলেন, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপরে ভরসা রাখুন। কোথাও কেউ কোনও রকম সংঘাতে যাবেন না।” প্রসঙ্গত, কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরী আগেই দাবি করেছিলেন যে, এসআইআর নিয়ে প্রথমে নানা রকমের হুঙ্কার দিলেও পরে এই প্রক্রিয়ায় সহায়তার পথেই হাঁটবে তৃণমূলও।
এসআইআর-কে স্বাগত জানিয়ে এ দিন রাতে নন্দকুমারে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেছেন, “সাফসুতরো ভোটার তালিকা হওয়া উচিত। ভুয়ো ও অনুপ্রবেশকারী কেন ভোটার তালিকায় থাকবে? প্রত্যেক ভারতীয়ের জন্য নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রয়োজন।”
এসআইআর-এর কাজে বুথ লেভল অফিসারদের (বিএলও) হুমকির মুখে পড়ার আশঙ্কা নিয়ে শুভেন্দুর বক্তব্য, “আইনশৃঙ্খলার অবনতি হলে নির্বাচন কমিশন ব্যবস্থা নেবে। এসআইআর নিয়ে আমাদের কোনও চিন্তা নেই। চিন্তা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের!” এসআইআর প্রক্রিয়া ডিজিটাল করার দাবি জানিয়ে বিজেপির রাজ্য সভাপতি শমীক ভট্টাচার্য বলেছেন, “ভোটার তালিকাকে ভুয়ো নাম মুক্ত করতে আমরা ঘরে-ঘরে পৌঁছব। বাংলাকে ভুয়ো ভোটের দুষ্ট-চক্র থেকে মুক্ত করব। যে নাগরিকের জন্ম এই মাটিতে, তাঁর ভোটাধিকার কাড়া যাবে না।”
আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে এ দিন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম জানিয়েছেন, তাঁদের দলের নানা দফতর থেকেই ২০০২ সালের ভোটার তালিকা পাওয়া যাবে। তাঁর বক্তব্য, “প্রতিটা নির্বাচনের আগে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মানুষকে ভয় দেখানো হয়। তবে ভয়ের কিছু নেই। সিপিএম কর্মীরা মানুষের পাশে আছেন।” তিনি বলেছেন, রাজ্য জুড়ে সিপিএমের বুথ লেভল এজেন্টরা (বিএলএ) সতর্ক থাকবেন, যাতে কোনও ভাবে বৈধ ভোটারের নাম বাদ না যায়। সেলিমের সংযোজন, “কোনও ভাবে মানুষের ভোটাধিকারকে সঙ্কুচিত করা যাবে না। আমরা দেখছি কখনও কমিশনকে ব্যবহার করে, কখনও গুন্ডা নামিয়ে ভোটাধিকারের উপরে আক্রমণ চলছে। গরিব মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।”
প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শুভঙ্কর সরকার মনে করান, “আমরা বিহারের এসআইআর-প্রক্রিয়ার প্রেক্ষিতে ১৬ দফা সংশোধনের দাবি জানালেও কমিশন কোনও প্রস্তাবই গ্রহণ করেনি। কমিশন যে ভাবে একটি ত্রুটিপূর্ণ প্রক্রিয়া পশ্চিমবঙ্গের ৭.৬৬ কোটি ভোটারের উপরে চাপিয়ে দিয়েছে, তা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। বাংলার মানুষের ভোটাধিকার ও নাগরিকত্ব সুরক্ষিত রাখতে দল রাজনৈতিক ও আইনি পদক্ষেপ করবে।” তাঁর দাবি, দাবি-আপত্তি গ্রহণ পর্বের পরে ৫৩ দিনের একটি অতিরিক্ত ধাপের সংযোজন হয়েছে, যখন নোটিস জারি করে শুনানি ও যাচাই করা হবে। এই সামান্য পরিবর্তন যথেষ্ট নয়।
বাংলা-সহ ১২টি রাজ্যে এসআইআর নির্ঘণ্ট ঘোষণার সময়ে এপিডিআর, ‘নো এনআরসি মুভমেন্ট’, আইএফটিইউ-সহ ১৬টি সংগঠনের ডাকে ওই প্রক্রিয়া বাতিল চেয়ে কলেজ স্ট্রিটে কফি হাউসের সামনে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ হয়েছে।