গত কয়েক দিন যত বারই সোশ্যাল মিডিয়ায় এসেছি, পহেলগামে ঘটে যাওয়া নারকীয় হত্যালীলার ছবি আর ভিডিয়ো দেখে শিউরে উঠেছি। আতঙ্ক! আবার? ১৯৯০-এর পর আবার নিরীহ মানুষ টার্গেট? বেচারারা ঘুরতে গিয়ে এই ভাবে বেঘোরে প্রাণ হারাল! কিন্তু কাশ্মীর তো আতঙ্কমুক্ত ছিল। তা হলে? তা হলে এত দিন যাকে আমরা ভূস্বর্গ বলতাম, সেটা কি ভুল?
কী করে ভুল বলি? সাধারণ লোক যে ভাবে কাশ্মীরকে দেখে,আমি সে ভাবে কাশ্মীর দেখিনি। ২০১৯ থেকে ২০২৪-এর মধ্যে বার ছয়েক গিয়েছি আর প্রতি বারই নতুন করে প্রেমে পড়েছি। জায়গার এবং মানুষজনের। আমি কাশ্মীরকে আমার ‘সেকেন্ড হোম’ বলি, সকলেই জানে। তার অনেক কারণ আছে। এক, কাশ্মীর আমার লেখার রসদ জোগায়। আর দুই, ওখানকার লোক। যেহেতু আমি ওদের ভাষা কিছুটা জানি এবং কাশ্মীরি লোকগীতি গাইতে পারি, সেই সূত্রেই ওদের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব। কেউ পুলিশে কাজ করে, কেউ টেলর, কেউ গাইড, আবার কেউ পড়াশোনা করে। কিন্তু সকলে আমাকে প্রাণভরে ভালবাসে। মঙ্গলবারের ঘটনার পরে মনে হল, তা হলে আমার ধারণাটা ভুল?
না, হতেই পারে না। তা হলে গুলাম মহম্মদ রাজু, যার বাড়িতে আমি থাকি, আমার বলে দেওয়ার পরে যার সঙ্গে অনেকে কাশ্মীর বেড়িয়ে এসে ভূয়সী প্রশংসা করেছে, সে যখন জানল আমি ওদের ভাষা জানি… মনে আছে, দু’দিন ওর গাড়িতে শ্রীনগর ঘুরিয়েছিল। যত বার টাকা দিতে গিয়েছি, বলেছে, ‘আপসে ক্যায়া পয়সা লেনা হ্যায়? আপ তো হমারে হো।’ সে আমায় নিয়ে ক্ষীর ভবানী মন্দিরে গেল কেন? শুধু গেলই না, আমার সঙ্গে দাঁড়িয়ে পুজো দিল কেন? আমার আর এক বন্ধু সমীর আহমেদ কেন বলেছিল, ‘চলিয়ে ভাই, শঙ্করাচার্য মন্দির চলতে হ্যায়?’
প্রথম বার আমি যখন বন্ধুর বাড়ি থাকি, ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আমি হিন্দু। এখানে থাকলে পাড়ার লোকেরা তোমায় কিছু বলবে না তো?’ জানতে চেয়েছিলাম, কারণ ১৯৯০-এর পণ্ডিতহত্যা তখনও আমার মনে গেঁথে। সে বলেছিল, ‘আপনি আসুন, তারপর দেখুন না কী হয়।’ সে বার সারা পাড়ার লোক আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল, আমি কলকাতা থেকে এসেছি শুনে।
আমার এমন অভিজ্ঞতাও হয়েছে যে, রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি, অচেনা এক কাশ্মীরি আমায় ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি কে, সেখানে কী করতে গিয়েছি। সবটা শোনার পরে বললেন, ‘আসুন না, আমার বাড়িতে এক কাপ চা খেয়ে যান।’ আচ্ছা, আমরা কলকাতা শহরে এখন আর কাউকে এ ভাবে বলি?
কাশ্মীর পালটাচ্ছে বলে জানতাম। টুরিজ়ম বাড়ছে, লাগাতার সিরিজ়, সিনেমার শুটিং হচ্ছে, সিনেমা হল খুলল চোখের সামনে, দু’বছর আগে। এই প্রজন্মের কেউ ওখানে সিনেমা হলে গিয়ে ফিল্ম দেখেনি তার আগে। তাদের সে কী উৎসাহ! ক্যানভাসটা একটু একটু করে রঙিন হচ্ছিল। হঠাৎ কেউ লাল রংটা বেশি ঢেলে তছনছ করে দিল। আবার ব্যাক টু স্কোয়ার ওয়ান।
পহেলগামের ঘটনার পরে বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, অটো এবং ট্যাক্সি অ্যাসোসিয়েশন গোটা কাশ্মীর জুড়ে বিনামূল্যে পর্যটকদের বিমানবন্দরে ছেড়ে আসছে। কই, কোনও এয়ারলাইন্স সংস্থা তো বলল না, ‘আসুন আপনাদের বিনাপয়সায় বাড়ি পৌঁছে দিই?’ পাড়ায় পাড়ায় মোর্চা বেরিয়েছে দেখলাম, যুবসমাজ গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে, ‘কাতিলো কো সজ়া দো।’
সেই যুবসমাজ, যারা কয়েক বছর আগে স্টোন পেলটিং-এর খাতায় নাম লিখিয়েছিল। যারা অবসর সময়ে ড্রাগের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকত। তারাও আর ওই জীবনটায় ফিরতে চায় না বলেই মরিয়া হয়ে রাস্তায় নেমেছে। একটা ছেলেকে বলতে শুনলাম, ‘বহুত ডর লগ রহা হ্যায়। লগতা হ্যায় সব খতম হো গয়া।’ ওই অন্ধকার জীবনটায় ফিরে যাওয়ার ভীতি তাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। আর এটাই তো অনেকে চায়। একবার কোমরটা ভেঙে দিতে পারলে টাকার লোভ দেখিয়ে ফের এদের সন্ত্রাসবাদের আখড়ায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। বোঝাবে, যে পথের দিশা তারা পেয়েছিল, সেটা ভুল।
তবে জাত, ধর্ম সব ভুলে যে ভাবে কাশ্মীরের মহিলা, পুরুষ, বাচ্চা, বুড়ো সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে পথে নেমেছে, আলো জ্বলবেই। আর সেই আলোকিত কাশ্মীর সব ভুল মুছে আবার সগৌরব মাথা তুলে দাঁড়াবে।