কোথায় আঘাতে ‘সর্বোচ্চ ফল’
ভারতের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন পাকিস্তানের দশ গুণ। আন্তর্জাতিক প্রভাবের প্রশ্নেও ইসলামাবাদকে ছাড়িয়ে গিয়েছে নয়াদিল্লি। ঐতিহ্যগত ভাবে পাকিস্তানের ‘বন্ধু’ অনেক রাষ্ট্রই হয় তাদের পক্ষ ত্যাগ করেছে, নয়তো ভারতের দিকে ঝুঁকেছে। সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এখন সবচেয়ে বেশি বিদীর্ণ। তাদের পশ্চিম সীমান্ত অশান্ত হয়ে রয়েছে আফগানিস্তানের সঙ্গে শত্রুতায়।
আঘাত হানার জন্য এই ‘সুসময়’ সত্ত্বেও পাকিস্তানের সেনা সামর্থ্যকে খাটো করে দেখছে না নয়াদিল্লি।
কিন্তু পহেলগামে তাদের মদতে যা ঘটেছে, তাতে বড় ঝুঁকি নেওয়া ছাড়া আপাতত প্রধানমন্ত্রী মোদীর অন্য উপায় নেই বলেই মনে করা হচ্ছে। এক কূটনৈতিক কর্তার মতে,
ভারত-পাকিস্তানের যে কোনও সংঘাতই কিছু না কিছু পরিবর্তন আনে। তা সত্ত্বে এত দিন টিকে গিয়েছিল সিন্ধু জলচুক্তি। অন্য দিকে পাকিস্তান শিমলা চুক্তি বারবার লঙ্ঘন করলেও আনুষ্ঠানিক ভাবে তারা কখনও তা বাতিল করেনি। কিন্তু এখন দু’দেশের সম্পর্ক এমন পর্যায়ে গিয়েছে যে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি এবং সমঝোতা অদূর ভবিষ্যতে ধসে পড়তে পারে বলে তিনি মনে করছেন।
সূত্রের মতে, সে সব কারণে পহেলগাম হামলার ঠিক পরই তাড়াহুড়ো করে প্রত্যাঘাতের রাস্তায় হাঁটেনি মোদী সরকার। পাকিস্তান সেনার উপর সর্বোচ্চ আঘাত হানা যাবে এমন স্থান ও কাল খুঁজে দেখা হচ্ছে। এ কথাও জানানো
হচ্ছে, দীর্ঘ অপেক্ষার প্রশ্ন নেই। বিহারের বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী পাকিস্তানের মাটিতে সন্ত্রাসবাদের ঘাঁটি ধ্বংস করার অভিপ্রায় জানিয়েছেন। পরমাণু যুদ্ধের আশঙ্কাকে (যে কারণে ২০০৮-এ মুম্বই হামলার পর সামরিক অভিযান করেনি ইউপিএ সরকার) উড়িয়ে দিয়ে মোদী এবং তাঁর পরামর্শদাতারা ২০১৬ সালে ‘সার্জিকাল স্ট্রাইক’ (উরি-কাণ্ডের প্রত্যাঘাতে) করেন, ২০১৯ সালে পুলওয়ামার পর পাকিস্তানে সন্ত্রাসের ঘাঁটিতে বোমাবর্ষণ করে ভারতীয় বিমানবাহিনী। কিন্তু বারবার প্রত্যাঘাত চালিয়ে গিয়েছে পাকিস্তানের মদতপ্রাপ্ত জঙ্গি সংগঠনগুলি। উরি হামলার দু’মাসের মধ্যে জম্মুর নাগোরটায় জইশ-এর আক্রমণে ১০ জন সেনার প্রাণ যায়। আবার ২০১৮ সালে জম্মুতেই এক সেনা ছাউনিতে হামলায় ১১ জনের মৃত্যু ঘটে। বালাকোটের পর থেকে বারবার আঘাত ফিরিয়েছে পাকিস্তান, যা হিসাবের মধ্যে রাখা হচ্ছে।
চিনের ভূমিকাকেও নজরে রাখতে চাইছে নয়াদিল্লি। ২০১৯-এ জম্মু ও কাশ্মীরে ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ প্রত্যাহারের পর চিন ইসলামাবাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদেই তারা বিষয়টিকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল, ২০২০-তে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা একতরফা ভাবে বদলে দিয়েছিল। এ বারে অবশ্য আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে শুল্ক যুদ্ধের জেরে তাদের ভারত-নির্ভরতা ২০২০-র থেকে কিছুটা হলেও বেশি।
কাজটা তাই নয়াদিল্লির কাছে সহজ নয়। সামরিক আঘাত হানার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার আগে, পি-৫ ভুক্ত সব রাষ্ট্রের সঙ্গে এবং জি২০-র বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রের সঙ্গে কথা বলে আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসের বিষয়টি বিস্তারিত বলেছে সাউথ ব্লক। জানা গিয়েছে, এই বৈঠকগুলি ‘অত্যন্ত কার্যকর’ হয়েছে। সহযোগিতার আশ্বাস পাওয়া গিয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসনকেও পাশে পাওয়ার আশা করেছে নয়াদিল্লি। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে আজই সে দেশের জাতীয় গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান তুলসী গাবার্ড এক্স হ্যান্ডলে বলেছেন, ‘জঘন্য ইসলামি সন্ত্রাসবাদী হামলার প্রশ্নে ভারতের প্রতি সহমর্মিতা জানাচ্ছি। পহেলগামে ২৬ জন হিন্দুকে মেরে ফেলা হয়েছে। এই জঘন্য আক্রমণ যারা করেছে, তাদের খুঁজে বের করার কাজে আমরা ভারতের পাশে রয়েছি।’
সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলিকে পুঁজি জোগানের ক্ষেত্রে নজরদারি আন্তর্জাতিক সংস্থা এফএটিএফ-এর সঙ্গেও যোগাযোগ করেছে নয়াদিল্লি। পাকিস্তানের সংগঠনগুলিকে কঠোরতম শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে ঐকমত্য তৈরির চেষ্টা হচ্ছে। বিভিন্ন সূত্রে এ কথাও বলা হচ্ছে, যে ভয়ঙ্কর ঘটনা জঙ্গিরা ঘটিয়েছে, তাতে সীমান্তবর্তী অঞ্চলে পাকিস্তানের মাটিতে ভারত-বিরোধী জঙ্গি শিবিরগুলিকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করার পথেই হাঁটতে হবে মোদী সরকারকে।