হৃদয়ে মন্দ্রিল ডমরু...
রবীন্দ্রনাথের অফুরান সৃষ্টির সঙ্গে নিসর্গের যোগ বর্ণনা করতে করতে— বৃষ্টি কী ভাবে ছেয়ে থাকত কবির ভুবনে, সত্যজিৎ রায় তা দৃশ্যায়িত করেছিলেন ক্যামেরায়। বিস্তীর্ণ আকাশ জুড়ে পুঞ্জীভূত মেঘে চরাচরব্যাপী বর্ষা, উড়ন্ত পক্ষীকুল, বৃক্ষরাজি, ভাসমান নৌকা, অকূল নদী... সাউন্ডট্র্যাকে কোরাসে কবিরই গান: ‘হৃদয়ে মন্দ্রিল ডমরু গুরু গুরু,/ ঘন মেঘের ভুরু কুটিল কুঞ্চিত,/ হল রোমাঞ্চিত বন বনান্তর’...
সঘনবর্ষণশব্দমুখরিত এই অসামান্য ইমেজখানি মনে আছে নিশ্চয়ই অনেকেরই, যাঁরা কবির জন্মশতবর্ষে তৈরি রবীন্দ্রনাথ (১৯৬১) তথ্যচিত্রটি দেখেছেন। এই প্রামাণ্য চিত্রনির্মাণের দায়িত্ব যখন বর্তায় সত্যজিৎ রায়ের উপর, জওহরলাল নেহরু বলেছিলেন, কাজটি যিনি করবেন তাঁকে প্রধানত হতে হবে শিল্পী। ইতিহাস-তথ্যাদি থাকলেও সে-ছবির প্রধান রস যেন হয় শিল্পের রস।
কথাগুলি মনে রেখেছিলেন সত্যজিৎ, দেশ পত্রিকায় দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে লেখার সময় সেই নিবন্ধটির নাম দিয়েছিলেন ‘শিল্পী-দরদী জওহরলাল’। দিল্লিতে জওহরলাল নেহরু যখন রবীন্দ্রজীবনীচিত্রটি দেখেন, কেমন আবেগবিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন— সে-লেখায় সত্যজিৎ তা জানান। সঙ্গে সঙ্গে ওই লেখাতেই ‘অপু ট্রিলজি’ সম্পূর্ণ করার ব্যাপারেও নেহরুর অবদানের কথা জানাতে ভোলেন না। দিল্লিতে রাষ্ট্রপতি ভবনে অপরাজিত (১৯৫৬) দেখার পর “পণ্ডিতজির মন্তব্যটি আমার স্পষ্ট মনে আছে— ‘অপুর জীবনের অনেক কিছুই বাকি রয়ে গেল কিন্তু। অন্তত আর একটি খণ্ড কি আমরা দেখতে পাব না?’ প্রকৃতপক্ষে পণ্ডিতজির মন্তব্যেই হল অপুর সংসার ছবির সূত্রপাত।” লিখেছেন সত্যজিৎ।
নেহরুর সঙ্গে সত্যজিতের শেষ দেখা শান্তিনিকেতনেই, ১৯৬২-র পৌষে, বিশ্বভারতীর সমাবর্তন উৎসবে। জওহরলালের অবয়বে দেশের রাজনৈতিক অবস্থা গভীর ভাবে রেখাপাত করেছে তত দিনে, মনে হয়েছিল সত্যজিতের। বুঝতে পারছিলেন, মানবিকতায় অটল বিশ্বাসী এক জন মানুষ মানবজাতিরই কোনও নির্দিষ্ট অংশের অমানুষিকতায় পীড়িত হয়েছেন। “রবীন্দ্রনাথকেও শেষ জীবনে এই দুঃখ সহ্য করতে হয়েছিল— ‘সভ্যতার সংকট’ এর সাক্ষ্য বহন করে।” এমন মন্তব্যে সত্যজিতের এ-রচনাটি শুধু নয়, কবিকে নিয়ে তাঁর ছবিটিও শেষ হয়।
ক্ষমতাসীনদের দর্পের প্রতাপে সভ্যতার সেই সঙ্কট আজও এমন ভাবে অব্যাহত, এবং ঘনীভূত— যাতে প্রয়াণের প্রায় সাড়ে তিন দশক পরেও সত্যজিৎকে অসম্ভব জীবন্ত এবং প্রাসঙ্গিক মনে হয়। এমন মনে হওয়ার কারণ নিশ্চয়ই তাঁর চলচ্চিত্র-আখ্যানের মৌলিকতা, যা ছদ্ম সৌন্দর্যনিষ্ঠা ছাপিয়ে অর্জন করে আনে সত্য।
কিন্তু সে-সত্যকে শিল্পের সত্য করে তোলেন কী করে সত্যজিৎ? নিসর্গ-নির্ভরতা যেমন তাঁর একটি অন্যতম অত্যাবশ্যক শিল্প-প্রকরণ। পর্দায় কোনও একটি মুহূর্তের ইমেজকে নিসর্গের নানাবিধ ডিটেলে ভরাট করে তোলেন তিনি, সেগুলির প্রত্যেকটিরই তথ্যমূল্য থাকে, সংলাপনির্ভর ভাষার চেয়ে এই ডিটেলসমৃদ্ধ ভাষা অনেক বেশি বিকীর্ণ বা ‘ডিফিউজ়ড’। ওই ইমেজের অন্তর্গত মূল ভাবনার দিকে দর্শকের দৃষ্টি নিবদ্ধ করার দায়িত্ব পরিচালক হিসেবে সব সময়ই কাঁধে তুলে নেন সত্যজিৎ। তাঁর কর্মময়তার সমগ্রের দিকে গোড়া থেকে ফিরে তাকালে মনে হয়, রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন আর তার নিসর্গ সম্ভবত সত্যজিতের শিল্পস্বভাবে তেমনই কোনও ‘স্পেস’ বা পরিসর তৈরি করে দিয়েছিল।
অথচ সেখানে প্রথমে যেতেই চাননি সত্যজিৎ। গত শতকের ত্রিশের দশকে তিনি ভালবাসতেন কলকাতার চৌরঙ্গির ভিড়ে মিশে যেতে, কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাত থেকে সস্তায় পুরনো দামি বই খুঁজে বার করতে, চোরাবাজারের ঘিঞ্জি অঞ্চল চষে নামমাত্র দামে পশ্চিমি মার্গসঙ্গীতের রেকর্ড কিনতে, কিংবা সিনেমাহলের ঠান্ডায় হলিউডের কল্পলোকে হারিয়ে যেতে। কিন্তু সুপ্রভা রায়, মা’র পীড়াপীড়িতে অনেকটাই নিমরাজি হয়ে শান্তিনিকেতন যাওয়া। চল্লিশের দশকের শুরুতে যে সময় তিনি সেখানে ছিলেন, ভারতীয় শিল্পের ট্র্যাডিশনকে চিনতে পারলেন। শান্তিনিকেতন হয়ে উঠল তাঁর আরও এক পৃথিবী, সেখানে উদার উন্মুক্ত শূন্যতা, তার উপর ধূলিবিহীন আকাশের চাঁদোয়া, মেঘমুক্ত কোনও রাত্রে সেখানে দেখা যেত নক্ষত্রপুঞ্জ— যা কোনও শহরের কোনও আকাশেই কোনও দিনও দেখা যাবে না। সেই আকাশ এক-এক দিন ছেয়ে যেত অন্ধকার মেঘের ঘনঘটায়, ছিল খোয়াই, নদীর ধার ঘেঁষে প্রহরারত তালগাছের সারি, আর কোপাইয়ের সর্পিল বহতা এবড়োখেবড়ো উঁচুনিচু খাত ধরে। শান্তিনিকেতন তাঁর শহরের গদ্যময় জীবনে এনে দিয়েছিল ভাবুকতা, মুগ্ধ বিস্ময়ের ঘোর। যে-হেতু প্রকৃতির কাছাকাছি কখনওই তাঁর থাকার সুযোগ ঘটেনি, শান্তিনিকেতনে এসে শিখলেন নিসর্গকে কী ভাবে দেখতে হয়।
রবীন্দ্রনাথ ছবির প্রায় এক দশক পর বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের শিল্প নিয়ে দি ইনার আই (১৯৭১) তৈরি করতে শান্তিনিকেতন গিয়ে দেখেন আবহাওয়া বদলে গেছে, গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। একটি একা তালগাছ-সমেত ছোট্ট এক চিলতে খোয়াই খুঁজে পেতে সত্যজিৎ-সহ তাঁর ইউনিটকে প্রায় দশ মাইল ঘুরতে হয়েছিল। কিন্তু সেই চল্লিশের দশকে স্বাধীনতা-পূর্ব শান্তিনিকেতন কেমন ছিল, সবিস্তারে বলেছিলেন ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়কে: “আজকের মতো এত জনবহুল ছিল না। তখন যে কোনও একটা জায়গায় দাঁড়ালেই দিগন্তরেখা দেখা যেত।... লক্ষ করতাম ঝড়ে, কিংবা বাতাসে, কিংবা বৃষ্টিতে গাছপালা কী ভাবে আচরণ করে— এই সব কিছু।” (সত্যজিৎ রায়/সুবর্ণ সাক্ষাৎ সংগ্রহ, সম্পা: সন্দীপ রায়/ বিচিত্রা গ্রন্থন বিভাগ)। নিসর্গের নিঃশব্দ দৃশ্যময় পরিবেশ সত্যজিৎকে প্রত্যুষ আর প্রদোষকালের তফাত বুঝিয়েছিল, আসন্ন বর্ষার গুমোট থমথমে ভাব, শরৎ আর বসন্তের রোদের তফাত, এ রকম কত কী চিনিয়েছিল!
পথের পাঁচালী (১৯৫৫) থেকে শুরু... রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ছবি করার সমসময়ে বা একটু পরে কাঞ্চনজঙ্ঘা (১৯৬২) কিংবা অভিযান (১৯৬২) নির্মাণের সময় পর্যন্ত নিসর্গের প্রতি তাঁর এক ধরনের দায়বদ্ধতা সদাপ্রস্তুত থাকত যেন। প্রকৃতির প্রতি সত্যজিতের এই ‘প্যাশন’, পথের পাঁচালী-র থেকে কোথাও কম ছিল না কাঞ্চনজঙ্ঘা বা অভিযান-এ, মনে করেন মারি সিটন। সত্যজিৎকে নিয়ে তাঁর বই (পোর্ট্রেট অব আ ডিরেক্টর: সত্যজিৎ রায়) রচনার সময় দীর্ঘকালব্যাপী তাঁদের পারস্পরিক বন্ধুত্ব থেকেই মারি-র উপলব্ধি: “অ্যাজ় রে হ্যাড আ ‘ফিল’ ফর পিপল, সো হি হ্যাড ফর নেচার’স মুড।” আবার এও বলেছেন মারি, এই যে প্রকৃতির প্রতি মুগ্ধতা, নিসর্গের প্রতি আসক্তি, শান্তিনিকেতন ছাড়া তার আরও এক উৎস— তাঁর পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর।
শান্তিনিকেতন থেকে দুবরাজপুর খুব একটা দূরে নয়, সেখানেই শুটিং হয়েছিল অভিযান-এর। এত দিনে সে-ছবির ‘রেস্টোর্ড ভার্সন’ প্রকাশ করেছে অ্যাকাডেমি অব মোশন পিকচার্স, এ বছর সত্যজিতের ১০৪ বছর পূর্তির জন্মদিনে দর্শকদের কাছে মুখ্য আকর্ষণ ছিল সেই ছবিই। ছবিটির আলোচনা মারি সিটনের বইয়ের অনেকখানি জুড়ে, সেই সঙ্গে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়েরও। অপুর সংসার-এর (১৯৫৯) অপু থেকে উমাপ্রসাদ (দেবী, ১৯৬০), অমূল্য (সমাপ্তি, ১৯৬১) হয়ে কী ভাবে অভিযান-এর নরসিং হয়ে উঠছেন তিনি, অচ্ছেদ্য গ্রন্থি যেন সত্যজিতের ছবির নিসর্গ আর মানুষের টানাপড়েনে।
সত্যজিতের শেষ ছবি আগন্তুক (১৯৯১)-এ মনোমোহনই ছবির কেন্দ্রিকতা কিংবা ভরকেন্দ্র। কোনও ভান না রেখে সত্যজিৎ স্পষ্ট জানিয়েছিলেন, “আগন্তুক-এ আমি উৎপলকে বলে দিয়েছিলাম যে, উৎপল, তুমি কিন্তু আমার স্পোকসম্যান এটা মনে রেখো।” তবে কি তাঁর শেষ ছবিতে ঘুরে আসছিল আত্মজৈবনিকতার কোনও ঝোঁক, সেই ‘অটোবায়োগ্রাফিক আর্ট’ যার মধ্যে মনস্তাত্ত্বিকেরা খুঁজে পান শিল্পীর আত্ম-পুনর্নির্মাণের প্রয়াস— ‘অ্যাটেম্পট টু রিকনস্ট্রাক্ট দ্য সেল্ফ’?
যে ধর্ম বা জাত আমাদের মধ্যে এত ভেদ, হিংসা, হানাহানির জন্ম দেয়, তা মানেন না মনোমোহন। ফলে পরম মঙ্গলময় ঈশ্বরের উপর আস্থা রাখা তাঁর পক্ষে ক্রমশই কঠিন হয়ে পড়ছে, ছবিতে বলেছিলেন তিনি। মনে থাকতে পারে কারও, মৃত্যুর ঠিক মাস দশেক আগে সত্যজিৎও এক বার বলেছিলেন, মঙ্গলময় ঈশ্বর যদি থাকেন তবে মানবিক মূল্যবোধের এমন সমূহ ক্ষয় কেন।
দেশ ছাড়ার আগে শান্তিনিকেতন ছুঁয়ে যান মনোমোহন, সাঁওতাল-নাচের আয়োজন করেন, তাঁর চোখ দু’টি জ্বলতে থাকে কোল আর সাঁওতালদের আদিম ঐতিহ্যের গল্পে, তাঁদের ব্রিটিশ-বিরোধী বীরত্বের গল্পে। ওই সাঁওতাল-নাচের উল্লেখ করে সত্যজিৎ সম্পর্কে লিখেছিলেন শঙ্খ ঘোষ: “যুক্তিবাদী সভ্যতার বাইরে গিয়ে দাঁড়াবার একটা আগ্রহ খুব স্পষ্ট তাঁর একেবারে শেষ ছবি আগন্তুক-এর মধ্যে।”
সত্যজিতের সেই আগ্রহেরই কি অন্তর্লীন এক পরিসর ছিল শান্তিনিকেতন, আর তার নিসর্গ?