চেক তামাদি হয় তিন মাস পেরিয়ে গেলে; আর, তিনশো বছর ব্যবহারের পর ক্রমে তামাদি হতে চলেছে চেক বই। পুরু, রঙিন কাগজের লম্বা ফালি, তাতে ব্যাঙ্কের নকশার জলছাপ, টাকার অঙ্ক লেখার বাক্সের নীচে স্বাক্ষরের জায়গা— লেনদেনের বিশ্বে আজ সে পুরাতন, বাতিলের দলে। এখন এসেছে বৈদ্যুতিন লেনদেন। তৎক্ষণাৎ টাকা চলে যায়, খরচ কমে। গ্রাহকের হাতের লেখা উদ্ধার করতে গিয়ে ব্যাঙ্ক-কর্মীর দাঁত কিড়মিড় করা, চেক-এর তারিখ বা অ্যাকাউন্ট নম্বর লিখতে গিয়ে ভুল করে গ্রাহকের হাত কামড়ানো, এ সব বন্ধ হল বলে। এক শ্রেণির ব্যাঙ্ক-কর্মী আবার সই-বিলাসী। গভীর মনোযোগের সঙ্গে পনেরো বছর আগে জমা-দেওয়া গ্রাহক-স্বাক্ষরের সঙ্গে সদ্য জমা-পড়া চেক খুঁটিয়ে দেখে, প্রচণ্ড প্রত্যয়ের সঙ্গে রায় দেন— চেক-এর সই মিলছে না। ব্যাঙ্কের খুপরিতে দাঁড়ানো গ্রাহকের মনে জেগে ওঠে অস্তিত্বের সঙ্কট— সেই আমি কি এই আমি? মওকা বুঝে ছবি-পরিচালকরা রোম্যান্সের কাজেও লাগিয়েছেন চেক নিয়ে বচসাকে— দীনেন গুপ্তের বসন্ত বিলাপ ছবিতে ব্যাঙ্ক-কর্মী নায়কের ভূমিকায় ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। একশো বাহান্ন নম্বর টোকেন নিয়ে অপেক্ষারত নায়িকা অপর্ণা সেনকে ডেকে বেশ ডাঁটের মাথায় জানিয়ে দেন, চেক-এ ‘ওভাররাইটিং’ আছে, চলবে না। আত্মপ্রত্যয়ী একটি মেয়ের মুখে ক্ষণিকের অসহায়তা দেখার মজাটুকু অবশ্য নিমেষে মুছে যায়, যখন ছদ্মব্যস্ততার শেষে নায়ক খেয়াল করেন যে টেবিলের অপর দিকে শূন্যতা, সুইং ডোর দুলছে— চেকখানা ‘চালিয়ে দেওয়া’র মিনতি না জানিয়ে অভিমানী মেয়ে চলে গিয়েছে।
এ বার মান-অভিমানের পালা শেষ। টাকা লেনদেনের মধ্যে থেকে সরে যাচ্ছে মানুষে-মানুষে দেখাসাক্ষাতের লেনদেন। চেক-এর ব্যবহার দ্রুত কমছে। বছর কুড়ি আগে ভারতে নগদ-ভিন্ন লেনদেনের ৯৫ শতাংশই হত চেক-এর মাধ্যমে। আজ তা ১০ শতাংশেরও কম। বেশ কিছু দেশ ইতিমধ্যেই চেক বইকে পাঠিয়ে দিয়েছে জাদুঘরে— ফিনল্যান্ড নব্বইয়ের দশকেই চেক ব্যবহার বন্ধ করেছে; ডেনমার্ক, নিউ জ়িল্যান্ডেও চেক এখন অচল। আগামী সেপ্টেম্বর থেকে আমেরিকার ফেডারাল সরকারও চেক দেওয়া-নেওয়া বন্ধ করবে। উদ্দেশ্য সাশ্রয়— বৈদ্যুতিন মাধ্যমে লেনদেনের তুলনায় চেক-এর খরচ প্রায় দশ গুণ বেশি। পিছু হটছে ডেবিট কার্ডও— মোবাইল ফোন আসার পর টেলিফোনের গুমটি (কিয়স্ক) যেমন অতীতের স্মারক হয়ে রয়ে গিয়েছে, তেমনই কিছু দিন পরে ফ্রিজ ম্যাগনেট বা চাবির রিং-এ দেখা যাবে এটিএম-কেও। স্মার্টফোন ব্যবহার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে ‘ইউনিফায়েড পেমেন্টস ইন্টারফেস’ বা ইউপিআই-এর ব্যবহার। ডিজিটাল লেনদেনের অধিকাংশই এখন ইউপিআই-এর দখলে, ভারতে যার যাত্রা শুরু ২০১৬ সালে।
দশ বছরের শিশুর কাছে তিনশো বছরের প্রপিতামহীর পরাজয়— প্রযুক্তিচালিত দুনিয়ায় এ হয়তো আশ্চর্য নয়। ব্যবসায়ীর বা আর্থিক সংস্থার লিখে দেওয়া কাগজ, বা ‘ব্যাঙ্ক নোট’-এর ব্যবহার বহু প্রাচীন। তবে ব্যাঙ্ক অব ইংল্যান্ড বিশেষ কাগজে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে লেখা ছাপানো চেক প্রথম বার করেছিল ১৭১৭ সালে, সেটিকেই আধুনিক ব্যাঙ্কিং-এর চেক ব্যবস্থার সূচনা মনে করা হয়। কাগুজে চেক যত পিছু হটবে, তত কমবে কলমের ব্যবহারও। হাতঘড়ির মতো, কলমও ক্রমশ কাজের জিনিস থেকে বাহারের জিনিস হয়ে উঠবে। কমবে ডাকঘরে যাওয়ার দরকার— খামে ভরে চেক পাঠানোর হ্যাপা আর থাকবে না। বাণিজ্য হয়তো আরও গতি পাবে, কিন্তু ডাকঘর, ব্যাঙ্ক, মুদির দোকান, দৈনন্দিন লেনদেনের সূত্রে যেখানে সরাসরি দেখা হত মানুষে-মানুষে, সেই সবই ক্রমে মিলিয়ে যাচ্ছে। পাঁচ ইন্দ্রিয়ের ভোজেও যেন একটু ঘাটতি, চেক-এর পুরু কাগজের উপর ধনকুবের মোটা পেনের কালির টানে খসখস করে লিখে দিচ্ছেন একটা সংখ্যা, তাতে শূন্যের সংখ্যা দেখে চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে, তবে না সম্পদের গরিমা? এখন গ্রাহকের পাওনা কেবল মোবাইলে ‘টুং’ শব্দ— দশ টাকাতেও ‘টুং’, আর দশ কোটি টাকা ঢুকলেও ‘টুং’। চেক বাউন্স করার সম্ভাবনাও অতীত হবে— অ্যাকাউন্টে টাকা থাকলে তবেই ইউপিআই চলে, নচেৎ নয়। আরও আফসোস, কোনও এক জন কোনও এক দিন ‘ব্ল্যাঙ্ক চেক’ লিখে দেবে, এই আশার সমাপ্তি হবে চেক বইয়ের তিরোধানের সঙ্গে। দাতা সইটি দিয়ে দিলেন, গ্রহীতা বসিয়ে নিলেন নিজের ইচ্ছেমতো অঙ্ক— এই অসীম দানশীলতা, অথবা সীমাহীন দাম্ভিকতা, কি আর ডিজিটাল মাধ্যমে সম্ভব?