অবক্ষয়ের ছবি
সায়নদেব চৌধুরীর ‘রাজনীতি ও খেলার প্রতিভা’ প্রবন্ধ প্রসঙ্গে কিছু ব্যক্তিগত উপলব্ধির বিষয়ে জানাতে চাই। গত জানুয়ারিতে গিয়েছিলাম বন্ধুর ছেলের বৌভাতে। অনুষ্ঠানের স্থান ছিল, তাঁদের নিজেদের বাড়ি। সাময়িক বসার স্থান তাঁর বড় ছেলের চেয়ে ১২ বছরের ছোট, ছোট ছেলের পড়ার ঘরে। দেখি চার দিকের দেওয়ালে শুধু, বিরাট, রোহিত, বুমরা, শুভমনদের ছবির পোস্টার। বুঝলাম বন্ধুর ছোট ছেলের সম্পদ। চোখে পড়ল একটু ছিঁড়ে যাওয়া সচিন, দ্রাবিড় আর জ়াহিরের ছবি। বুঝে নিলাম সেগুলো আজকের বর মানে ওর দাদার কীর্তি।
মন চলে গেল ষাট-সত্তরের দশকে আমার পড়ার ঘরে। দেওয়ালে টাঙানো নেতাজি, ঋষি অরবিন্দ আর বিবেকানন্দের ছবি। আজ সে সব মনীষীর স্থান নিয়েছেন গণমাধ্যমের তৈরি করা ‘ভগবান’রা। আমার বাড়িতে আসত স্পোর্ট অ্যান্ড পাসটাইম আর পরবর্তী কালে স্পোর্টসউইক। ভালবাসতাম ক্রিকেট আর তার রাজকীয় শিল্প, সৌন্দর্য আর ভদ্রতাকে। মাঠে প্রথম দিকে পটৌদি পরে ভিভ রিচার্ডসদের হাঁটাচলা অবাক হয়ে দেখতাম। শতরান করুন বা শূন্য, শৌর্যে কোনও ফারাক নেই। টেস্ট ম্যাচের টিকিট পেলে মনে হত হাতে চাঁদ পেলাম। এই ছিল খেলাটার মর্যাদা। দর্শকরা ছিলেন উদারমনা। মনে আছে সত্তরের দশকে বিশ্বনাথের অর্ধশতরানে যত করতালির আওয়াজে ইডেন মুখরিত হয়েছিল, রয় ফ্রেডেরিক্সের শতরানের জন্য করতালিতে ইডেন ছিল ততটাই মুখরিত। ২০২৩-এর বিশ্বকাপ ফাইনালে ভারতের বিরুদ্ধে অস্ট্রেলিয়ার ট্র্যাভিস হেডের শতরানের পর আমদাবাদের স্টেডিয়ামে করতালির আওয়াজ শোনা গেল কই?
নব্বইয়ের দশকের একেবারে প্রথম থেকে ক্রিকেটটা যখন এ দেশে ঠান্ডা পানীয় ব্যবসায়ীদের হাতে চলে গেল, তখন তাঁরা তাঁদের মতো করে ক্রিকেটের নতুন ব্যাকরণ সাজালেন। শেখালেন, টেক্সট বুক শট বা শৈল্পিক মারগুলো কোনও কাজের নয়। কারণ ফিল্ডাররা বহু ক্ষেত্রেই এই শটগুলো বাউন্ডারি হওয়ার আগেই ধরে নেন। তাই এমন মার শিখতে হবে যাতে বাউন্ডারি হবেই। যদি চার-ছক্কা না মারা যায় তা হলে আর খেলে কী লাভ? তাই শিল্প, সৌন্দর্য তফাত যাক। লেট কাট, লেগ গ্লান্স, ব্যাক ড্রাইভ, হুক— এই সব সুন্দর শট ছেড়ে নিয়ে আসতে হবে কুৎসিত সব মারমারকাটকাট ব্যাট ঘোরানো। যেমন রিভার্স সুইপ! ডাংগুলির ডান্ডা ধরার মতো ব্যাট ধরে স্কুপ, উইকেটকিপারের মাথার উপর দিয়ে তুলে মার ইত্যাদি।
সত্তরের দশকে অস্ট্রেলিয়ার সৌজন্যে এল স্লেজিং। তবু ভদ্রতা ছিল। ছিল শতরানের পর বিপক্ষ দলের কাছাকাছির ফিল্ডারদের করমর্দন, আর দূরে থাকা ফিল্ডারদের করতালি। বোলার ভাল বল করলে ব্যাটারের মাথা ঝাঁকিয়ে প্রশংসাসূচক অভিবাদন ছিল। আজ এই নতুন ব্যাকরণের ক্রিকেট-ভাষ্যে ব্যবসায়ী আর রাজনীতিবিদদের ইচ্ছায় বিপক্ষের সঙ্গে সুসম্পর্কের ইতি ঘটেছে, খেলোয়াড়রা এখন পরস্পরের শত্রু। খেলা, খেলোয়াড় সকলের চরিত্র বদলে গিয়েছে।
গণমাধ্যমের দৌলতে ভারতে ক্রিকেট তারকারা প্রায়শই ঈশ্বরের মর্যাদা পান। কারণ? তাঁরা এই প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করছেন! ভক্তরা প্রিয় তারকাদের অন্ধ ভাবে অনুসরণ করেছেন, তা সে কেশ বিন্যাস অনুকরণ হোক বা তাঁদের দ্বারা বিজ্ঞাপিত পণ্য ব্যবহার করা হোক। আমরা বিরাট কোহলি, মহেন্দ্র সিংহ ধোনি এবং অন্য বিখ্যাত ক্রিকেটারদের দ্বারা প্রচারিত অসংখ্য বিজ্ঞাপন দেখি, কিন্তু তাঁরা কি বিশাল ভক্তকুলের কাছে আদৌ সৎ থাকছেন? তাঁদের আবেগের মূল্য দিতে যথেষ্ট চিন্তা-ভাবনা করছেন?
সোমনাথ মুখোপাধ্যায়
কলকাতা-৫৭
বড় মাঠ চাই
সায়নদেব চৌধুরীর ‘রাজনীতি ও খেলার প্রতিভা’ প্রবন্ধ প্রসঙ্গে কিছু কথা। এক সময় ফুটবল বাঙালি ও ভারতীয়দের বড় নিজের ছিল। আর হকির সাফল্যে গর্ব অনুভব করতেন প্রত্যেক ভারতীয়। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে যে সব আন্তর্জাতিক খেলাতে আমাদের মেডেল-তৃষ্ণা কিছুটা মিটেছে, সেগুলো প্রায় সবই দলগত নয়, ব্যক্তিগত খেলা। ব্যাডমিন্টন, টেনিস, দাবা। অলিম্পিক্সেও ধারাবাহিক সাফল্য এসেছে কুস্তি, ভারোত্তোলন, শুটিং, তিরন্দাজির মতো ব্যক্তিগত খেলায়। তা হলে কি দলগত খেলা বলতে আমাদের দেশে শুধু ক্রিকেটেরই রাজপাট থাকবে? অথচ এখনও ডার্বিতে মাঠ কানায় কানায় ভরে যায়। তবে কেন ফুটবলের বিশ্ব-তালিকায় আমরা এত দেশের পরে?
বোদ্ধাদের কারও মত— টাকা নেই, বিজ্ঞাপন নেই, রোল মডেল নেই। কারও মত— দক্ষতা নেই, শারীরিক গঠন ও পুষ্টির অভাব ইত্যাদি। কিন্তু এগুলো ঠিক কথা নয়। আগে ফুটবলের দক্ষতা বলতে ড্রিবলিং, গোলে শট মারা, ডিফেন্স করা, গোল বাঁচানো বোঝানো হত। এর প্রশিক্ষণের জন্য পুরো মাঠ লাগত না। কিন্তু আধুনিক ফুটবলে প্রশিক্ষিত হতে গেলে পায়ের সব কাজ ছকে ফেলে আদর্শ মাপের মাঠ (১০৫ x ৬৮ মিটার) জুড়েই অভ্যাস করতে হয়। শুধু অনুশীলন করার জন্য এই মাপের মাঠ আমাদের দেশে খুব কম আছে।
আমাদের দেশজ ফুটবলকে আন্তর্জাতিক মানে তুলে আনতে হলে এমন আন্তর্জাতিক পর্যায়ের আয়তন-সম্পন্ন বহু মাঠ প্রয়োজন। আশা করি, সরকার ও বিভিন্ন উদ্যোগপতির সহায়তায় স্বপ্নের মাঠগুলি পাওয়া যাবে এবং উপযুক্ত পরিচর্যায় উঠে আসবে বড় মাঠের খেলোয়াড়।
সোমেশ সরকার
শেওড়াফুলি, হুগলি
মায়াজাল
রাস্তাঘাটে, ট্রেনে-বাসে, ঘরের মাঝে সর্বত্রই মানুষ আজ নতমস্তকে সমর্পিত যন্ত্রের কাছে। তা হল মোবাইল! এখন খেলার মাঠগুলো ফাঁকা, তালাবন্ধ লাইব্রেরিগুলো! ফেসবুক, ওয়টস্যাপ, সিনেমা, ওয়েবসিরিজ়— বিনোদনের হরেক মশলাদার উপাদান মজুত মুঠোফোনে! স্বভাবতই আগ্রহ কমছে ছাপার অক্ষরের প্রতি। এই মায়াজালের ফাঁদ এড়াতে জনসচেতনতা গড়ে তোলা চাই।
সৈকত কর্মকার
গোবরডাঙা, উত্তর ২৪ পরগনা