কমেডির স্রোতে ভেসে...
হাস্যরসের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বার্তা দেওয়া— এ কাজ হামেশাই করে থাকে চলচ্চিত্র। তবে গল্পের জোর, চিত্রনাট্যের বুনটের উপরে নির্ভর করে সবটা। আর নির্ভর করে পরিচালকের মুনশিয়ানার উপরে। পথিকৃৎ বসুর ‘শ্রীমান ভার্সাস শ্রীমতী’ ছবিটির ক্ষেত্রেও আলোচ্য বিষয় ঠিক সেটাই। এই ছবিতে কমেডি থেকে ইমোশন, মায় বুড়ো হাড়ে অ্যাকশন পর্যন্ত রয়েছে। অভিজ্ঞ শিল্পীদের নিয়ে এ বারও মাঠে নেমেছিলেন পরিচালক। ব্যাটে-বলে হল কি?
তরুণ দম্পতি সৌরভ আর অমৃতার (পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় ও মধুমিতা সরকার) বিবাহবিচ্ছেদ আটকে দেয় দুঁদে বিচারপতি অমল চৌধুরী (মিঠুন চক্রবর্তী)। এ দিকে সেই বিচারপতির নিজের বিবাহবিচ্ছেদের মামলা চলছে ২৭ বছর ধরে। জটিলতা আরও বাড়ে, যখন স্ত্রী অপর্ণার (অঞ্জনা বসু) জীবনে ফেরত আসে তার কলেজবেলার প্রেমিক নিলয় সেন (অঞ্জন দত্ত)। অমল-অপর্ণাকে মিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে করতেই ছবি এগোতে থাকে।
মিঠুন ও অঞ্জন, মৃণাল সেনের দুই অভিনেতাকে একফ্রেমে নিয়ে আসার কাজটি (দুঃসাহসও বলা চলে) করে ফেলেছেন পথিকৃৎ। তা তিনি সামলাতে পেরেছেন কি না, সে প্রশ্ন অবশ্য আলাদা। দুই মহারথী খুব কম ফ্রেমেই একসঙ্গে এসেছেন। কিন্তু যখন এসেছেন, গভীরতা যোগ করেছেন পর্দায়। বিশেষ করে মধ্যান্তরের পর থেকে যখন অঞ্জন প্রবেশ করলেন, মোড় ঘুরিয়ে দিলেন এক্কেবারে। যেমন করে বাংলা আধুনিক গানের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল তাঁর ‘রঞ্জনা’, ‘বেলা বোস’, ‘মেরি অ্যান’... তেমনই প্রথম বার বাণিজ্যিক ছবিতে মারকাটারি পারফরম্যান্সে তাক লাগালেন অচেনা অঞ্জন। মাছের বাজারে গুণ্ডা পেটাচ্ছেন অঞ্জন দত্ত, এ দৃশ্য বাঙালি আগে দেখেনি!
অন্য দিকে, চিত্রনাট্যে আলগোছে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে মিঠুনের হাত ভাঙার প্রসঙ্গটি। কারণ সত্যি সত্যিই ভাঙা হাত নিয়ে গোটা ছবির শুটিং করেছিলেন অভিনেতা। এ ছবিতে তাঁর আর অঞ্জনা বসুর রসায়ন জমাট। বিশেষ করে আবেগের দৃশ্যগুলিতে মিঠুন অদ্বিতীয়। তুলনায় পরমব্রত, মধুমিতার সাংসারিক দিকটি চিত্রনাট্যে দরকার মতো আনা হয়েছে মাত্র, খুব গভীরে যাওয়া হয়নি। মিঠুন, অঞ্জনের সঙ্গে জুড়ে থাকা কিছু শব্দবন্ধকে নানা সংলাপে জুড়ে দেওয়া হয়েছে ইচ্ছে করেই। তবে এ ছবির কমেডির অ্যাপ্রোচটি মূলত মোটা দাগের।
বিয়ের মতো প্রতিষ্ঠানকে বাঁচিয়ে রাখতে গেলে কী করণীয়, তা হালকা চালে দেখাতে চাওয়া হয়েছে এ ছবিতে। তা করতে গিয়ে পুরো বিষয়টিই গুরুত্ব হারিয়েছে। কোর্টরুমের তরজা থেকে মামলার মিটমাট— সবটাই যেন ঠাট্টার ছলে। ফলে সিরিয়াস দৃশ্যগুলিও লঘু হয়ে যায় কখনও কখনও। তবে অমল-অপর্ণার বিয়ের সময়কার ফ্ল্যাশব্যাকের অংশটি উপভোগ্য। উচ্চকিত আবেগ সেখানেও রয়েছে, তবুও ওই অংশটি সত্যম ভট্টাচার্য, রোশনি ভট্টাচার্যের অভিনয় গুণে সুন্দর উতরে গিয়েছে।
সদ্য বিবাহিত স্বামী-স্ত্রীর ‘রোল রিভার্সাল’-এ ভাঙা দাম্পত্য জোড়া লেগে যাওয়ার মতো অতিসরলীকরণ করা হয়েছে গল্পের শুরুতেই। অন্য দিকে, বরিষ্ঠ দম্পতির ভাঙা সম্পর্ক জোড়া লাগাতে বিবেকের মতো আনা হয়েছে প্রবাসী প্রেমিকের চরিত্রটিকে। ছবি জুড়ে একাধিক ইন-ফিল্ম বিজ্ঞাপনী প্রচার, ডিটেলের প্রতি অবহেলা গুণমান নষ্ট করেছে অনেকটাই। একটি দৃশ্যে স্বামীর উদ্দেশে অপর্ণা বলে ওঠে, ‘‘৩০০ সুগার নিয়ে মিষ্টি খেতে যাচ্ছ, লজ্জা করে না?’’ পরের দৃশ্যেই স্বামীকে আলু পোস্তর বাটি হাতে ধরিয়ে দেয় সে।
সারা ছবি জুড়ে অঞ্জনা বসুর অভিব্যক্তি প্রায় একই রকম বিষাদক্লিন্ন, যা তাঁর চরিত্রটির সঙ্গে মানানসই। পরমব্রতের বিশেষ কিছু করার ছিল না এই ছবিতে। মধুমিতার অভিনয়েও আবেগের আতিশয্য। বিশ্বনাথ বসু তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে সাক্ষীগোপালের ভূমিকাটি পালন করেছেন। তনিমা সেনের কৌতুক মোটের উপরে হাসির উদ্রেক করলেও কোথাও মাত্রা ছাড়িয়েছে।
অঞ্জন এই ছবির জন্য তাঁর সিগনেচার স্টাইলে নতুন একটি গান বেঁধেছেন, যা শুনতে বেশ লাগে। এ ছাড়া শিলাজিতের গানটির প্রয়োগও চমৎকার। ‘উলু দাও’, ‘মনখারাপ’-সহ সব ক’টি গানই যত্ন নিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে ছবিতে, যার কৃতিত্ব প্রাপ্য সঙ্গীত পরিচালক ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তের। ক্যামেরা কখনও কোর্ট চত্বর, কখনও কুমোরটুলি, প্রিন্সেপ ঘাটে ঘুরে বেড়িয়েছে। ঘরে-বাইরের ব্যালান্স যথাযথ ভাবে ধরেছে গোপী ভগতের ক্যামেরা।
মজার ছলে কিছু সামাজিক সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করায় ‘শ্রীমান ভার্সাস শ্রীমতী’। চিরচেনা অভিনেতাদের নতুন মোড়কে পেশ করে দর্শকের সামনে। সে মোড়ক খুলে দর্শক কী পেলেন, সে নিদান তাঁদেরই।
সায়নী ঘটক