খেলছিল আমার ছেলে, এখন আবার অন্ধকার
সাবির ইবন ইউসুফ l শ্রীনগর
১০ মে: স্বস্তি ফিরেছিল। আমার ছেলেটা খেলছিল। কিন্তু তা মাত্র চার ঘণ্টার জন্য।
টানা কয়েক দিনের আতঙ্ক, ভয়, বিনিদ্র রাত কাটিয়ে শনিবার বিকেলে জানা গেল, ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষবিরতি প্রস্তাবে রাজি হয়েছে। যখন কপি লিখতে বসেছিলাম, মনে হচ্ছিল অনেক ক্ষণ দমবন্ধ থাকার পরে যেন শান্তির দীর্ঘশ্বাস ফেলছি। কিন্তু রাত ৮টায় ফের বিস্ফোরণের শব্দ। খবর এল, ডাল লেকে নিভে গিয়েছে শিকারার আলো। মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা পোস্ট করলেন, ‘সংঘর্ষবিরতির হলটা কী।’ ফের আতঙ্কে ডুবে গিয়ে আমরা সকলেই ভাবছি, হচ্ছেটা কী?
সংঘর্ষবিরতির খবর পাওয়ার পরই আমার ছেলে মহম্মদ মুসা বাড়ির সামনের মাঠে বন্ধুদের সঙ্গে ফুটবল খেলতে শুরু করে। ও ক্লাস সিক্সে পড়ে। এই প্রথম বার এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে তার খেলা বন্ধ। ঘরে চুপচাপ বসে থাকত। দূরে বিস্ফোরণ বা সাইরেনের শব্দ শুনলে ভয়
পেয়ে আমাকে বা আমার স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরত।
আজ বিকেলে যখন পরিচিতদের থেকে ফোন পেয়েছি, কারও গলায় আর আগের মতো আতঙ্ক নেই। সবাই বলছেন, বাইরে বেরিয়ে চা খেয়ে আড্ডা দেওয়ার কথা। ভাবছিলাম, কত দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা যায়, যা আমরা গত কয়েক দিন ধরে প্রবল ভাবে চেয়ে এসেছি। এই মুহূর্তে খুব খারাপ লাগছে ভেবে যে কিছু ক্ষণ আগেও শ্রীনগরের রাস্তায় ফিরে এসেছিল স্পন্দন। ঝিলম নদীর কাছে আইসক্রিম, চা-কফির দোকান খুলছিল। দমবন্ধ শহর ফের গা ঝাড়া দিয়ে উঠছিল। কত তাড়াতাড়ি রং বদলাচ্ছে এই শহরের, আমাদের ঘরবন্দি জীবনের। শুক্রবার রাতের কথাই ধরুন না। তখন সন্ধে সাড়ে সাতটা। নিস্তব্ধতা ভেঙে পরপর বিস্ফোরণের শব্দ ভেসে আসছিল শ্রীনগরে। যদিও বিস্ফোরণ যেখানে ঘটেছে, তা আমার বাড়ি থেকে অনেকটাই দূরে।
প্রথমে আমি সেই শব্দ শুনে তেমন পাত্তা দিইনি, কারণ শ্রীনগরে অনেক সময়েই এমন শব্দ আগেও শোনা গিয়েছে। সংঘাতপ্রবণ এলাকায় থাকলে এই ধরনের শব্দ স্বাভাবিক। কিন্তু রাত আটটা ১৭ মিনিট নাগাদ ভয় শুরু হয়। পরপর তিনটি শক্তিশালী বিস্ফোরণে আমার ঘর প্রবল ভাবে কেঁপে ওঠে। বাড়ির জানালা-দরজা, দেওয়াল সব থরথর। বাচ্চারা ভয়ে-আতঙ্কে আমাদের জড়িয়ে ধরে।
এর আগে অবন্তীপোরায় পুরনো বায়ুসেনা ঘাঁটির কাছে বিস্ফোরণের পরেই পুরো এলাকা বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে ঢেকে যায় অন্ধকারে। আলোর পাশাপাশি ফোনের সিগন্যালও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এই অবস্থায় শুধুই মাঝেমধ্যে বহুদূর থেকে ভেসে আসছিল বিপদঘণ্টির শব্দ।
রাত একটা নাগাদ অবসন্ন শরীরে শুতে যাই। আধঘণ্টা কাটতে না কাটতেই ফের পরপর তিনটি বিস্ফোরণের শব্দ। মনে হচ্ছিল যেন পৃথিবী আর্তনাদ করছে। সারারাত সে ভাবে আর ঘুম আসেনি। শনিবার ভোররাত সাড়ে চারটে নাগাদ বিছানা ছেড়ে উঠে বসি। সেই সময়েই আরও একবার বিস্ফোরণের শব্দ। এই বিস্ফোরণটি ঘটেছিল গুলমার্গে। গুলমার্গ শ্রীনগর থেকে কয়েক মাইল দূরে হওয়া সত্ত্বেও, ক্ষেপণাস্ত্রের বিস্ফোরণ এতটাই মারাত্মক ছিল যে, এত দূরেও শোনা গিয়েছে। এর পরে ভোর পৌনে ছ’টা নাগাদ পরপর দু’টি বিস্ফোরণ শ্রীনগর বিমানবন্দরে। শেষ বিস্ফোরণটি সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ ডাল লেকের দিকে। এমন একটা রাত সাম্প্রতিক অতীতে শ্রীনগর কখনও দেখেছে বলে মনে পড়ে না।
সেই অন্ধকার কেটে গিয়েছে ভেবেছিলাম আজ বিকেলে। কিন্তু আজকের রাত তা আর ভাবতে দিল কই! কাল সূর্য উঠবে। কিন্তু আমাদের আঁধার কাটবে কি?