কাশ্মীরে জঙ্গি হামলার নিন্দা করেছেন, কিন্তু পাকিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত সংঘর্ষ পাকাপাকি যুদ্ধের চেহারা নিক, চান না! সেই মতোই সমাজমাধ্যমে মন্তব্য করেছেন, অন্যের পোস্টে লাইক, কমেন্ট-ও করে রেখেছেন! তা হলে আপনি ‘দেশপ্রেমী’ হতে পারেন, তবে ‘রাষ্ট্রবাদী’ নন। অন্তত তেমনই মনে করছে রাজনৈতিক দলের ‘সেন্টিমেন্ট অ্যানালিসিস টুল’! অতঃপর তথ্য বিশ্লেষণকারী পদ্ধতি (ডেটা অ্যানালিসিস টুল) সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে যে গোত্রে ফেলছে, সেই মতোই হচ্ছে পরবর্তী কৌশল। বিধানসভা নির্বাচনের প্রায় বছরখানেক আগে থেকে এই পদ্ধতিতেও দলে টানার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে বলে রাজনৈতিক মহল সূত্রের খবর।
এ জন্য এই মুহূর্তে অন্যতম বিষয় হল ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষ। তার পরেই রয়েছে হিংসা, সম্প্রদায়ভিত্তিক নানা ঘটনাবলি এবং অনুপ্রবেশ। একটি রাজনৈতিক দলের
সমাজমাধ্যম সেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত কোঅর্ডিনেটর বললেন, ‘‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-নির্ভর কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশন পদ্ধতিতে ঠিক করে দেওয়া যায়, কোন বিষয়ে প্রচার চালাতে হবে। অনুন্নয়ন, চাকরি না থাকা, শিক্ষা-সহ নানা ক্ষেত্রে দুর্নীতির মতো বিষয়গুলি তালিকায় থাকলেও সেগুলিকে এই মুহূর্তে অতটা গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। বদলে যুদ্ধ, দেশপ্রেম, ধর্মীয় আবেগের ভিত্তিতে সমাজমাধ্যম ব্যবহারকারীর আলাদা আলাদা প্রোফাইল তৈরি করে দলে টানার কাজ চালানো হচ্ছে।’’
তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় কর্মরত সাইবার বিশেষজ্ঞ তন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘‘কুম্ভস্নান থেকে যোগ্য-অযোগ্য চাকরিপ্রার্থী, জঙ্গি হামলা থেকে সীমান্ত সংঘর্ষ— সাম্প্রতিক অতীতে নানা বিষয়ে আমরা মন্তব্য করেছি। কখনও কখনও অন্যের মন্তব্যকে সমর্থন জানিয়েছি বা বিরোধিতা করেছি। রাজনৈতিক দলের আইটি শাখা এই মন্তব্যগুলিকেই পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে। বোঝার চেষ্টা করা হয়, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ওই দলের সমর্থক না কি বিরোধী। সমর্থক হলে সমস্যা নেই, বিরোধী হলেই শুরু হয় দুর্বলতা খোঁজা।’’ একটি রাজনৈতিক দলের আইটি শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত বললেন, ‘‘হতে পারে কোনও ব্যক্তি কোনও রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীকে পছন্দ করেন না, তাঁদের বিরুদ্ধাচারণ করে নানা মন্তব্য করেন বা এই সংক্রান্ত ছবি-ভিডিয়ো শেয়ার করেন। কিন্তু ওই নেতার দল হয়তো যুদ্ধের পক্ষে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিও মনে করেন, যুদ্ধই একমাত্র যোগ্য জবাব! এই সূত্রেই এরপর শুরু হবে প্রভাবিত করার প্রক্রিয়া।’’
এ রাজ্যে বিজেপি-র সোশ্যাল মিডিয়া ইনচার্জ সপ্তর্ষি চৌধুরী জানান, বুথ, শক্তিকেন্দ্র, মণ্ডল, বিধানসভা, লোকসভা, জেলা এবং রাজ্যস্তর পর্যন্ত সাংগঠনিক কাঠামো অনুযায়ী তাঁদের আলাদা আলাদা আইটি এবং সমাজমাধ্যম শাখা রয়েছে। নেতা-নেত্রীর বক্তব্য, ডেটা ব্যাঙ্ক তৈরির
কাজ করে আইটি শাখা। সমাজমাধ্যম শাখার কাজ প্রচার চালানো। সপ্তর্ষির বক্তব্য, ‘‘বিনা পারিশ্রমিকেই কাজ করছেন এই কাজে যুক্তেরা। এই
মুহূর্তে তাঁদের প্রধান দায়িত্ব যুদ্ধের বিরুদ্ধে মেকি শান্তি চেয়ে যে অপপ্রচার চলছে, তার বিরুদ্ধে মতামত গড়ে তোলা।’’ সূত্রের খবর, এই কাজে বুথস্তরে ৫০ জন করে লোক নিয়ে
দল তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেককে দেওয়া হয়েছে আলাদা ল্যাপটপ এবং মোবাইল ফোন। এক-একটি ফোনে অন্তত ৪০০টি থেকে ৫০০টি ওয়টস্যাপ গ্রুপ আছে। প্রতি গ্রুপে সদস্য অন্তত ৩০০ জন। এ ছাড়াও রয়েছে টেলিগ্রামের মতো নানা অ্যাপ্লিকেশন। ব্যক্তিগত যোগাযোগ এবং এই সমস্ত অ্যাপ মিলিয়ে মাথাপিছু লক্ষ্য, এক লক্ষ লোককে দলে টানা। ভোটকুশলী একটি
সংস্থার কর্মী বললেন, ‘‘একটি বিধানসভা কেন্দ্রের মোট ভোটারের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ লোককেও যদি পক্ষে আনা যায়, তা হলেই যথেষ্ট। পাঁচ হাজার ভোটের পার্থক্যও অনেক সময়ে বড় ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।’’ তৃণমূলের আইটি এবং সমাজমাধ্যম শাখার প্রধান দেবাংশু ভট্টাচার্যও বললেন, ‘‘আমাদের ঘোষিত নীতি আন্তর্জাতিক প্রশ্নে কেন্দ্রীয় সরকারের অবস্থানকে সমর্থন করা। তবে আসন্ন নির্বাচনকে মাথায় রেখেই বাকি কাজ চলছে। বিএসএফ জওয়ানকে দেশে ফেরানোর ক্ষেত্রে তৃণমূলের ভূমিকাও প্রচারে রাখছে আমাদের
আইটি শাখা।’’
কিন্তু এই প্রচার কি দীর্ঘস্থায়ী হয়? ‘রিপ্রেজেন্টেশন অব দ্য পিপল অ্যাক্ট, ১৯৫১’ অনুযায়ী, ভোটের ৪৮ ঘণ্টা আগে সব ধরনের প্রচার নিষিদ্ধ। ২০১৯ সালে নির্বাচন কমিশন সংশোধনী এনে সমাজমাধ্যমেও
এমন পদ্ধতিতে প্রচার নিষিদ্ধ করেছিল। যদিও ব্যক্তিগত ওয়টস্যাপ গ্রুপ বা মেসেজে এমন প্রচার চালানোয় কোনও বাধা নেই
ভোটের আগের মুহূর্তেও। তৃণমূলের আইটি শাখার এক কর্মীর দাবি, ‘‘যত আগে কাজ শুরু হবে, ততই ভাল। এই মুহূর্তে ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষের দিকে নজর ঘোরানো সব পক্ষেই লাভজনক।’’