ইলা তাঁর হাতির দাঁতের মতো শুভ্র দুই বাহু দিয়ে মহারাজকে জড়িয়ে ধরলেন। মহারাজের অস্থির হাত রানির বসন
সরিয়ে দেয় দ্রুত। মহারাজকে উন্মত্ত করে তুলে রানি আজ তাঁকে জয় করে
নিতে পেরেছেন।
ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে তিনি মহারাজের কানে কানে বললেন, “রাজা, আমার একটা কথা রাখবে?”
মহারাজের দ্রুত শ্বাস পড়ছিল। তিনি ফিসফিসিয়ে বললেন, “নিশ্চয়ই।”
মহারাজকে আরও নিবিড় করে গ্রহণ করতে করতে ইলা বললেন, “শুনলাম, বড়রানি নাকি ছেলের কাছে দাক্ষিণাত্যে যেতে চাইছে। তুমি তাকে ওখানেই পাঠিয়ে দাও।”
মহারাজা যেন তীব্র আবেগে ইলার ওষ্ঠাধর দংশন করে তাঁর কথা বন্ধ করে দিলেন। মহারাজের আশ্লিষ্ট জিহ্বার স্পর্শে ইলা তার জবাব পেয়ে গিয়েছে। আনন্দের অশ্রুতে তাঁর কানের পাশে নিবিড় কেশ সিক্ত হয়ে উঠল।
অন্য দিকে সেই একই সময়ে মহারানি পদ্মাদেবী যেন সেই একই অভীপ্সা করলেন, “জানো বীরসিংহ, কত দিন আমি পুত্র বীরভদ্রকে দেখিনি। একা একা সে দাক্ষিণাত্যের যুদ্ধক্ষেত্রে পড়ে আছে। খুব ইচ্ছে করে দাক্ষিণাত্যে গিয়ে এক বার পুত্রকে বুকে জড়িয়ে ধরি। মহারাজের কাছে আগেও অনুমতি চেয়েছিলাম দাক্ষিণাত্যে যাওয়ার। মহারাজ অনুমতি দেননি।”
তিনি একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
বীরসিংহ খুবই বাক্পটু। এই সামান্য সময়ের মধ্যেই তার বাক্চাতুর্যে সে মহারানি পদ্মাদেবীকে মোহিত করে ফেলেছে। সে শুধু ধর্মের কথা শোনায় না। সে বরং শিষ্যদের চিরযৌবনের পাঠ পড়ায়। যৌবনের আনন্দেই তার মুক্তি। অবশ্য তার এই যুক্তি সাবেক বৌদ্ধরা মানতে পারেন না। আবার ব্রাহ্মণ আর বৈষ্ণবদের চাপে কোণঠাসা বৌদ্ধরা তাকে ফেলেও দিতে পারে না। অনেকই জানে না, বীরসিংহ গোপনে বৌদ্ধতন্ত্র সাধনাও করে। বৌদ্ধতন্ত্রের পাঠ সে সুদূর নেপাল থেকে শিখে এসেছে।
মহারানির কথায় সে মৃদু হাসল। মুখে বলল, “আপনি বিচলিত হবেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে। শুধু আপনি আপনার ইচ্ছাশক্তিকে জাগিয়ে তুলুন। দেখবেন, সব আপনার পক্ষে যাবে।”
বীরসিংহ কথা বলতে বলতে মহারানির চোখে চোখ রাখল। কী তীব্র সেই চোখের দৃষ্টি! পদ্মাদেবীকে একটি পানীয় পান করতে দিল সে। কী আছে সেই পানীয়ে, মহারানি তা জানতে চাইলেন না। মন্ত্রমুগ্ধের মতো বীরসিংহের চোখের দিকে তাকিয়ে মহারানি ধীরে ধীরে তা পান করলেন।
তার পর মহারানির মনে হল, তাঁর সারা শরীর যেন পালকের মতো ভারহীন হয়ে গিয়েছে। চোখের সামনে যেন একটা আলোর রেখা ফুটে উঠছে। সেই আলোর রেখা ক্রমশ ঝলমলে রোদের মতো হয়ে যাচ্ছে। সেই রোদের ও পারে অনন্ত নীল বারিরাশি। অনন্ত আকাশ। সেই আকাশে এক ঝাঁক সাদা পাখি উড়ে যাচ্ছে। সে দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মহারানির সারা শরীর যেন এক অনাবিল পুলকে ভরে যাচ্ছে।
বীরসিংহ অপলকে মহারানির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মন্থর হাতে মহারানির ঊর্ধ্বাঙ্গের বসন উন্মোচন করে দিল। এ বার মহারানির শরীরের দিকে তাকাল সে। যৌবনের প্রান্তসীমায় পৌঁছে মহারানির শরীরে যেন বিষণ্ণতার ছাপ। বীরসিংহ আলতো হাতে মহারানিকে স্পর্শ করল। কিন্তু মহারানির শরীর কেঁপে উঠল না। যেন কোনও শৃঙ্গার আভাসেই শরীর আর জেগে ওঠে না!
বীরসিংহ বুঝতে পারল, মহারানির এই বিষণ্ণ ক্লান্তির কারণ। সে স্থির করল, এই মৃতপ্রায় যৌবন তাকে জাগিয়ে তুলতে হবে। বীরসিংহ নিচু হয়ে আরও নিকটবর্তী, আরও ঘনিষ্ঠ হল মহারানির।
সহসা দরজার বাইরে এক অপ্রীতিকর শব্দ। মহারানির এক প্রিয় পরিচারিকা এত রাতে এই গোপন বিশ্রামকক্ষে আলো জ্বলতে দেখে উঁকি দিয়ে দেখতে গিয়েছিল। পরিচারিকাটি পুরনো। মন্থরার পাখি পড়ানোতে সে ভোলেনি। তার যেন কেমন সন্দেহ হয়েছিল। তাই সে চুপিচুপি দেখতে গিয়েছিল। কিন্তু সে দরজার সামনে যখনই পৌঁছেছে, তখনই একটি তীক্ষ্ণ ছোরা আমূল তার ঘাড়ের বিঁধে গলার কাছ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে। তার গলা থেকে একটা চিৎকার বেরোতে গিয়েও যেন বেরোল না।
আপাদমস্তক কালো কাপড়ে ঢাকা এক জন সেই দেহটিকে সরিয়ে নিয়ে গেল।
২২
পূর্ণিমা তিথি।
পূর্ণচন্দ্রের দিকে সাশ্রুনয়নে তাকিয়ে ছিলেন মহাপ্রভু। গম্ভীরার ক্ষুদ্র জানালা থেকে জগন্নাথ মন্দিরের চূড়া দেখা যায়। জ্যোৎস্নায় থইথই সে দিকে তাকালে মনে হয়, বহু দূরের স্বর্গ থেকে ঈশ্বরের সোনার রথ নেমে এসেছে মর্তে। মহাপ্রভু যেন সেই দৃশ্যই নয়ন ভরে দেখছেন। ভাবে বিভোর, তবু তিনি যেন কিছুতেই সর্বান্তঃকরণ দিয়ে ভগবানকে ডাকতে পারছিলেন না। এক কীট যেন বার বার এসে তাঁকে দংশন করে যাচ্ছে। অথচ এর কারণ তিনি জানেন। আর জানেন বলেই তিনি যেন আরও বেশি চিন্তিত হয়ে পড়েছেন।
মহাপ্রভু সংসারত্যাগী, পিছুটানহীন সন্ন্যাসী। সব কিছু ছেড়ে তিনি নীলাচলে এসেছিলেন একান্ত মনে কৃষ্ণ-ভজনা করবেন বলে। কিন্তু তিনি আবার ভাবলেন, শুধু কি কৃষ্ণভজনা? বৈষ্ণব ধর্মকে দিকে দিকে সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যও কি তিনি নীলাচলে আসেননি? স্বার্থপরের মতো তিনি একা কৃষ্ণ-রাধাকে আঁকড়ে থাকবেন কেন? ভগবানকে মানুষের মনের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। কিন্তু তিনি আবার ভাবেন, এই কি সন্ন্যাসীর ধর্ম?
একটা দ্বিধা তাঁর মনে কাজ করতে থাকে অহরহ। তার পরেই তাঁর মনের ভিতরে সহসা একটা বিপরীত ভাব কাজ করে। তিনি জানালার কাছ থেকে সরে এসে দেওয়ালে মাথা কুটতে থাকেন। সেই সঙ্গে প্লাবনের মতো তাঁর চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে এসে বুক ভাসিয়ে দেয়। বিলাপের মতো তাঁর মর্মস্থল থেকে একটা হাহাকার উঠে আসে, ‘এ আমি কী করছি? নিঃস্ব সন্ন্যাসী হয়ে আমি কি না রাজার সঙ্গে রাজনীতির আলোচনা করছি? সাধন-ভজন ছেড়ে রাজকার্যের বিষয় চিন্তা করছি?”
তাঁর কাঞ্চনবর্ণ কপাল রক্তবর্ণ হয়ে ওঠে।
আজ ঘরে স্বরূপ দামোদর নেই। তাই মহাপ্রভুকে পা ধরে শান্ত করারও কেউ নেই।
কিন্তু ঈশ্বরপ্রেরিত দূতের মতো সে রাতে সেখানে এসে উপস্থিত হলেন রায় রামানন্দ।
রাম রায় বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়লেন। এমন উদ্ভ্রান্ত অবস্থায় তিনি কখনও মহাপ্রভুকে দেখেননি। মহাপ্রভুর বেদনা যেন তাঁরও বেদনা। তিনি অশ্রু সংবরণ করতে পারলেন না। তিনি এগিয়ে গিয়ে মহাপ্রভুর হাত ধরে তাঁকে থামালেন।
“এ কী করছেন প্রভু? কেন আপনি এত অস্থির?”
রায় রামানন্দকে দেখে মহাপ্রভুর মনে হল, তিনি বুঝি একটা অবলম্বন পেলেন। তাঁর রাম রাজাকে তিনি আলিঙ্গন করে নিজেকে একটু শান্ত করতে চেষ্টা করলেন।
রাম রায় শক্ত করে প্রভুকে জড়িয়ে ধরে থাকলেন। নিশ্চুপ নিস্পন্দ। তিনি যেন মহাপ্রভুর অন্তর থেকে সমস্ত অস্থিরতাকে নিজের শরীরে গ্রহণ করে নিতে চাইলেন। মুহূর্তের পর মুহূর্ত এমন করে কেটে গেল। পাথরের দুই ভাস্কর্য যেন। তার উপরে গলিত রুপোর মতো চাঁদের আলো এসে পড়েছে।
রামানন্দ সাবধানে মহাপ্রভুকে তাঁর শয্যার উপরে উপবেশন করালেন। নিজে বসলেন তাঁর পায়ের কাছে। তার পরে শান্ত কণ্ঠে আবার বললেন, “প্রভু, আজ কেন আপনি এত অস্থির?”
মহাপ্রভু অস্থির গলায় বললেন, “রাজা, তুমিই বলো, সন্ন্যাসীর কি রাজনৈতিক বিষয় চিন্তা করা শোভা পায়? শোভা পায় কি রাজদর্শন?”
রায় রামানন্দ মৃদু হাসলেন। তাঁর মুখের উপরে চাঁদের আলো পড়ে সেই হাসিকে আরও উদ্ভাসিত করে তুলেছে। মহাপ্রভু সেই হাসি দেখে যেন প্রীত হলেন। রামানন্দর মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকলেন তিনি।
রামানন্দ সেই হাসি মুখে ধরে রেখে বললেন, “আপনার মতো সর্বজ্ঞ পণ্ডিতের মুখে কি এই কথা শোভা পায় প্রভু? আমি আপনাকে কী বলব! ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে অর্জুনের রথের সারথি হয়েছিলেন। প্রভু, আপনিই তো শিখিয়েছেন, দেবভক্ত হয়েও কী ভাবে রাজার রাজধর্ম পালন করা উচিত। সেই আপনার ভিতরেই কেন এত দ্বিধা!”
মহাপ্রভু চুপ করে রাম রায়ের কথা শুনলেন। আত্মমগ্ন হয়ে তিনি যেন কিছু ভাবলেন। তদ্গত ভাবেই বললেন, “তবু কি আমার শিক্ষায় কোথাও ভুল হয়ে যাচ্ছে? আমি তো সবার কাছে প্রেমের বাণী ছড়িয়ে দিতে চাইছি! তা সত্ত্বেও বৈষ্ণব ইষ্টগোষ্ঠীতে এত ঈর্ষা কেন? এত দ্বেষ কেন?”
রাম রায় যেন এত ক্ষণে প্রভুর বিচলিত হওয়ার কারণ সম্যক বুঝতে পারলেন। তিনি রাজকর্মচারী, তাই বিভিন্ন মানুষের স্বাভাবিক রিপুগুলির সঙ্গে তিনি পরিচিত। তাই তিনি ভাল করে উপলব্ধি করতে পারছেন, বৈষ্ণব গোষ্ঠীর কলেবর যত বৃদ্ধি পাচ্ছে, তত সেখানে বেনোজল ঢুকে পড়ছে। ভাল মানুষের রূপ ধরে ঢুকে পড়ছে নানা ধরনের ভণ্ড সন্ন্যাসী। অনেকে আবার নিজের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে এখানে ভক্তের ভেক ধরে ঢুকে পড়ছে। সেই সঙ্গে শুরু হয়েছে স্বার্থ-সংঘাতের কারণ স্বরূপ নানা রকমের বিবাদ-বিতণ্ডা। সেই বিবাদের সংবাদ আবার কেউ কেউ রং চড়িয়ে প্রচার করছে। ফলে ধীরে ধীরে একটা অস্থিরতা জন্ম নিচ্ছে সর্বত্র। সেই সঙ্গে রামানন্দ বুঝতে পারছেন, মহাপ্রভুর একটা বিরুদ্ধ গোষ্ঠী মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। হয়তো মহাপ্রভুর প্রতি গজপতি প্রতাপরুদ্রদেবের আনুগত্য রাজকর্মচারীদের অনেকেই ভাল চোখে দেখছে না। আর এই বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর সঙ্গে ভিতরে ভিতরে যোগ দিয়েছেন ব্রাহ্মণ-সমাজ। এই বিষয়ে রামানন্দ নিজেও কিছুটা বিচলিত।
“প্রভু, আপনি কি শিবানন্দ সেন আর কাহ্নাই খুণ্টিয়ার মধ্যে বিবাদের কারণে বিচলিত?”
“তুমি শুনেছ রাম রাজা?”
“প্রভু, আমার ধৃষ্টতা ক্ষমা করবেন। আপনি হয়তো সম্পূর্ণটা জানেন না। শিবানন্দ সেন আর কাহ্নাই খুণ্টিয়া প্রতি বছর রথযাত্রার সময়ে বহু ভক্তকে নীলাচলে নিয়ে আসেন। এতে তাদের উভয়েরই প্রভূত অর্থ উপার্জন হয়। কিন্তু সকল ভক্ত রথযাত্রার পরেই নীলাচল থেকে চলে যায় না। অনেকে কিছু দিন নীলাচলে থেকে যায়। ফলে তাদের জন্য উপযুক্ত থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে হয় উভয়কেই। এ বার তাদের এই থাকার ব্যবস্থা নিয়েই বিবাদ।”
একটু থেমে রামানন্দ বললেন, “আপনি এই নিয়ে আর বিচলিত হবেন না। আমি ব্যবস্থা করছি। আপনি আমার উপরে ভরসা রাখুন।”
মহাপ্রভু যেন একটু আশ্বস্ত হলেন। একটা হাসির রেখা তাঁর মুখে দেখা গেল। তিনি বললেন, “তাই তো তোমাকে রাজা বলি। তোমার কাছেই আছে সমস্ত সমাধান।”
পরদিন রায় রামানন্দ নিজে কাশী মিশ্রের কাছে উপস্থিত হয়ে, তাঁকে অনুরোধ করলেন এই সমস্যা সমাধানের। কাশী মিশ্রের মধ্যস্থতায় এই বিবাদ মিটে যায়।
কিন্তু সাময়িক ভাবে মিটে গেলেও বিবাদের একটা চোরা স্রোত সকলের অলক্ষে বয়ে যেতে লাগল। এর পিছনে অবশ্য নানা দিক থেকে ইন্ধন জোগানোর মানুষের অভাব নেই।
ভরদ্বাজ মিশ্র বেশ মিশে গিয়েছেন বৈষ্ণব গোষ্ঠীর ভিতরে। বৈষ্ণব সঙ্গীদের মধ্যে তাঁকে নিয়ে কেউ সন্দেহ করল না, কিন্তু রায় রামানন্দ যে তাঁকে সন্দেহের চোখে দেখেন, তা ভরদ্বাজের অজানা নয়। তাই ভরদ্বাজ এড়িয়ে চলেন রামানন্দকে। আবার তাঁর নিজের ব্রাহ্মণ সমাজও তাঁর এই বৈষ্ণবদের ভিতরে ঢুকে পড়াকে ভাল চোখে দেখছে না। কারণ ভিতরের খবর জানে শুধু সামান্য কয়েক জন পরিচিত ব্যক্তি।
ক্রমশ