সহজ কথা সহজ ভাবে বলতে পারাই কঠিন। বিশেষ করে সিনেমার ভাষায়। আর সেই কাজটাই করার চেষ্টা করেছেন সৌরভ পালোধী, ‘অঙ্ক কি কঠিন’ ছবিতে। সৌরভ এবং সৌমিত দেবের লেখা এই কাহিনি, চিত্রনাট্য কতকগুলো মানুষের গল্প বলে, যাদের চোখে একরাশ স্বপ্ন। এই গল্পের প্রধান চরিত্র তিন কচিকাঁচা, যারা নিজেদের একটা হাসপাতাল খুলতে চায়। তার অভিযানে নেমে পড়া এই তিন স্কুলছুটের গল্প নিয়েই ‘অঙ্ক কি কঠিন’।
অতিমারির পরে বন্ধ হয়ে যাওয়া স্কুল, নিউটাউনের জমিতে সিন্ডিকেট-রাজ, হিন্দু মেয়ের সঙ্গে মুসলিম ছেলের প্রেম, গরিবের চিকিৎসা না পাওয়া, টাকার বিনিময়ে গৃহসহায়িকাকে যথেচ্ছ কাজ করিয়ে নেওয়া… বৈষম্য, না পাওয়ার নানা বিষয় মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে এই ‘ছোটদের’ গল্পে। ছবির তিন খুদে— বাবিন, ডলি আর টায়ারের বন্ধুত্ব, তাদের একটা হাসপাতাল তৈরি করার ইচ্ছেয় ভর করে এগোয় ছবি। শেষে গিয়ে যখন সত্যিকারের বিপদ আসে, ছোটদের এই ছেলেখেলাই তখন পরিত্রাতা হয়ে ওঠে।
ঋদ্ধিমান, তপোময় আর গীতশ্রী— এই তিন খুদের অভিনয় ছবিটিকে ধরে রাখে। পর্দায় এরা অত্যন্ত সাবলীল, পরিণত অভিনয় করেছে। তবে সংলাপের বোঝা একটু বেশিই বইতে হয়েছে ওদের। শুধু শিশুরাই নয়, সারা ছবি জুড়ে প্রায় সব চরিত্রের মুখেই প্রয়োজনের অতিরিক্ত সংলাপ বসানো। এই ছবির মাধ্যমে যে বার্তা আসলে দিতে চাওয়া হয়েছে, তা সিনেমার ভাষায়, আরও নিরুচ্চারে দেওয়া গেলে ভাল হত। সমাজের প্রান্তবাসীদের রোজনামচা দেখাতে গিয়ে যে রেফারেন্সগুলি আনা হয়েছে, তা-ও খানিক ছকে বাঁধা। তবে কিছু দৃশ্যপট নির্মাণ প্রশংসার দাবি রাখে। ঝাঁ চকচকে ফ্লাইওভার ও বহুতলের বৈপরীত্যে টালির চালের বস্তি, পূর্ব কলকাতার জলাভূমি চিরে এগিয়ে যাওয়া সাইকেল-রাস্তা, বাচ্চাদের স্বপ্নের হাসপাতালের সেট… ভাবনার নতুনত্ব ধরা পড়েছে এ ছবির অনেক ফ্রেমেই। জীবনযুদ্ধে শ্রান্ত এক দিনমজুর যখন রঙিন আলো লাগানো অটোর মধ্যে বসে সন্তানের চোখ দিয়ে স্বপ্ন দেখে, মন ছুঁয়ে যায় সে দৃশ্য।
শঙ্কর দেবনাথ, পার্নো মিত্র, কৃষ্ণেন্দু সাহা, ঊষসী চক্রবর্তী, প্রসূন সোম-সহ ছবির বেশির ভাগ অভিনেতাই দক্ষ, যাঁরা নিজেদের চরিত্রগুলি অনায়াসে প্রাণবন্ত করে তুলেছেন। একটি বিশেষ চরিত্রে দেখা যায় দেবেশ চট্টোপাধ্যায়কে। টাকার বিনিময়ে শরীর বিক্রি করতে আসা এক নারীকে পাশে বসিয়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা বলে তাঁর চরিত্রটি। এক বৃদ্ধের চরিত্রও ফিরে ফিরে আসে, যে বাড়ি থেকে পালাতে চাওয়া এক কপোত-কপোতীর প্রেমের দৃশ্যে বার বার এসে পড়ে। একাধিক রূপক ব্যবহার করা হয়েছে ছবিতে। হিন্দু-মুসলমানের প্রেমে এসেছে শাহরুখ-কাজলের প্রসঙ্গ। তবে পরিচালক যা যা বলতে চান, তার একটা উচ্চকিত প্রকাশ দেখা গিয়েছে এ ছবিতে।
সঙ্গীত ও আবহে দেবদীপ মুখোপাধ্যায়ের কাজ ভাল লাগে। ছবির মধ্যকার সহজিয়া সুরটি তাঁর সঙ্গীতে সুন্দর ধরা পড়েছে। ‘আমাকে গল্প বল’, ‘চাপ নিয়ে লাভ নেই’-এর মতো গানগুলি মনে থেকে যায়। বাংলায় সার্থক র্যাপের উদাহরণ খুব বেশি নেই। ‘চাপ নিয়ে লাভ নেই’ সে দিক থেকে যথাযথ একটি প্রয়াস।
ইচ্ছে থাকলে যে সব সমস্যার সমাধানও করে ফেলা যায়, সেই আশার কথা বলে এ ছবি। বাস্তব থেকে তা হয়তো যোজনখানেক দূরে, কিন্তু শেষে গিয়ে সব ঠিক হয়ে যাওয়ার একটা প্রত্যয় তৈরি করে এমন গল্প। রুপোলি পর্দায় তো এমন গল্প দেখতেই ভাল লাগে!
সায়নী ঘটক