ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজমান কি না, তা নিয়ে যদি বা তর্ক থাকেও, প্লাস্টিক যে দুনিয়ার সর্বত্র বিরাজমান, তা সংশয়াতীত। পরিবেশ দার্শনিক টিমোথি বলেন যে, বিশ্ব উষ্ণায়ন, জলবায়ু বা তেল হল অ্যানথ্রপোসিন যুগের ‘হাইপারঅবজেক্ট’— যা কতকগুলো বস্তুর সমন্বয়, সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে যার ব্যাপক বিস্তার ঘটে, এবং যার প্রভাব স্থানীয় ভাবে বোঝা সম্ভব নয়। প্লাস্টিক এবং তার প্রভাবও তেমনই বৈশ্বিক— বিশেষত, মাইক্রোপ্লাস্টিকের তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব পড়ছে বিভিন্ন বাস্তুতন্ত্রে, যার ব্যাপকতা স্থানীয় ভাবে বোঝা অসম্ভব। সে নিরিখে, প্লাস্টিকও একটি ‘হাইপারঅবজেক্ট’।
বেশির ভাগ প্লাস্টিকের উৎপত্তিই স্থলে, কিন্তু আবর্জনা আকারে তা জমা হচ্ছে জলাভূমি, হ্রদ, নদী, সমুদ্রে। জলজ ও সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রে বিভিন্ন প্লাঙ্কটনের গুরুত্ব অপরিসীম, যে-হেতু এরা বিভিন্ন প্রজাতির খাদ্যের উৎস। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, এই সব প্লাঙ্কটন মাইক্রোপ্লাস্টিকের রাসায়নিক বর্জ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং খাদ্যশৃঙ্খলকে নষ্ট করছে। পুষ্টিচক্রে প্রভাব ফেলছে। এই প্লাঙ্কটন ও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীব প্লাস্টিকের উপর বসবাস করছে, জলে বর্জ্য পদার্থের এক রকম বাস্তুতন্ত্র তৈরি হচ্ছে, যাকে বলা যেতে পারে ‘প্লাস্টিস্ফিয়ার’।
এ ছাড়া, বহু প্রজাতি ঋতু পরিবর্তনের সময় এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বা অন্য দেশে যায়, সেখানে প্লাস্টিক দূষণের শিকার হয়, বা সেই প্রজাতি নিজেই দূষিত প্লাস্টিক বহন করে এবং সেই বাস্তুতন্ত্রেরও ক্ষতি করে। ফলে প্লাস্টিক দূষণ এক জায়গায় সীমাবদ্ধ থাকে না। এটা ছড়িয়ে পড়ে এক মহাদেশ থেকে আর এক মহাদেশে। ফলে সারা পৃথিবী প্রভাবিত হয়। পরিযায়ী পাখিরা ন্যানো প্লাস্টিক-দূষিত কেঁচো খায়। আবার মাছও খাদ্যশৃঙ্খলে দূষিত টক্সিন জমা করে। বিভিন্ন তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, সারা পৃথিবীতে নমুনা সংগৃহীত সমস্ত মাছে প্রায় ৫০% মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে। মানুষ সেই দূষিত খাদ্য খেয়ে চলেছে। ফলে এই দূষণ সমুদ্র, নদী এবং মোহনার বাস্তুতন্ত্রে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। মানুষের শরীরে এই দূষিত খাবার ঢুকছে এবং বিভিন্ন রোগ শরীরে বাসা বাঁধছে।
একটি হিসাব অনুযায়ী, সারা বিশ্বে প্রতি বছর ২৫১ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। এর সিকি ভাগ ‘অনিয়ন্ত্রিত বর্জ্য’, যেটা সরাসরি পরিবেশে মিশে অপূরণীয় ক্ষতি করছে। এই অনিয়ন্ত্রিত প্লাস্টিক বর্জ্যই বড় উদ্বেগের বিষয়। কারণ এই বর্জ্য পুনর্ব্যবহার হয় না, কোনও ‘ট্রিটমেন্ট’ও হয় না— এগুলি আবর্জনায় পরিণত হয়; বা খোলা আকাশের তলায় পোড়ানো হয়, যাতে তৈরি হয় কার্বন মনোক্সাইডের মতো ক্ষতিকারক গ্যাস। এতে জলবায়ু পরিবর্তন ত্বরান্বিত হয়। সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, প্লাস্টিক বর্জ্য জমে নিকাশি ব্যবস্থা অবরুদ্ধ হওয়ায় বহু শহর বন্যার কবলে পড়ছে। একটি রিপোর্ট বলছে, প্লাস্টিক বর্জ্যের কারণে নিয়মিত বন্যার ফলে প্রায় ২১.৮ কোটি গরিব মানুষের জীবনযাত্রা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
রাষ্ট্রপুঞ্জের রিপোর্ট অনুযায়ী, সামুদ্রিক বর্জ্যের ৮৫ শতাংশই প্লাস্টিক। এখন সামুদ্রিক বর্জ্যের পরিমাণ প্রায় ১৫০ মিলিয়ন টনের আশপাশে, যেটা ২০৪০ সালের মধ্যে প্রায় তিন গুণ হতে পারে। প্রত্যেক বছর আনুমানিক ১১ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক সমুদ্রে জড়ো হচ্ছে; ২০৪০ সালের মধ্যে তা ২৩-৩৭ মিলিয়ন টনে পৌঁছবে। আবার সমুদ্রে প্লাস্টিক কাঁচামালের কন্টেনার ডুবে গিয়েও দূষণ ঘটে।
১৯৫০ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে প্রায় ৯২০০ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক উৎপাদন হয়েছে। তার মধ্যে প্রায় ৭০০০ মিলিয়ন টনই পরিণত হয়েছে বর্জ্যে। এই বর্জ্যের ৭৫% ভাগাড়ে ফেলা হয়, যেটা সঠিক ভাবে পরিচালনা করা হয় না। আবার অনেক ক্ষেত্রে পরিবেশে পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকে বা সমুদ্রে জমা হয়। ২০১৯ সালের একটি রিপোর্ট বলছে, আফ্রিকা ও এশিয়া মহাদেশে বর্জ্যের অব্যবস্থাপনার ফলে কয়েক মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য স্থলজ ও জলজ বাস্তুতন্ত্রে ঢুকছে, এবং শেষে সমুদ্রে পড়ছে। যদিও ভারতে প্লাস্টিক বর্জ্য আমদানি করা নিষিদ্ধ, ২০২৩ সালে ২৫টির বেশি দেশ ভারতে ৭৮,০০০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য জড়ো করেছে।
আধুনিক জীবনে প্লাস্টিক অপরিহার্য, কিন্তু প্লাস্টিক ব্যবহার ও দূষণ কী ভাবে কম করা যায়, তা ভাবা প্রয়োজন। এমন একটি বৃত্তাকার অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পৌঁছনো দরকার, যেখানে নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে প্লাস্টিককে পুনর্ব্যবহারযোগ্য ও পচনশীল করা সম্ভব। এ কাজে সরকার উৎসাহ দিতে পারে। তা ছাড়া সরকারের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সঠিক, উদ্ভাবনী নীতি নেওয়া দরকার। নাগরিকদেরও যথাসম্ভব প্লাস্টিকের ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে।
আমরা দেখতে পাই, কিছু লোক ব্যক্তিগত উদ্যোগে আবর্জনার স্তূপ বা ভাগাড় থেকে অত্যন্ত বিপজ্জনক ভাবে প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করেন রোজগারের পথ হিসাবে। এঁরা অনেকেই প্লাস্টিক নিঃসৃত রাসায়নিক পদার্থের বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত। গোটা দেশে এঁদের সংখ্যা প্রায় ১৫ লক্ষ, যাঁরা সকল সামাজিক ও আইনি সুরক্ষার বাইরে। এঁদের অন্তর্ভুক্তির কথা ২০১১ সালের প্লাস্টিক ওয়েস্ট (ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড হ্যান্ডলিং) রুলস-এ বলা আছে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে না। এঁদের সংগঠিত করে সঠিক প্রশিক্ষণ দিয়ে এই কাজে নিযুক্ত করলে এক দিকে তাঁদের রোজগারের পথ সুগম হয়, অন্য দিকে পরিবেশেরও উপকার হয়। এ ব্যাপারে বেসরকারি সংস্থা অগ্রণী ভূমিকা নিতে পারে। ইতিমধ্যে আবর্জনা সংগ্রহকারীরা সমবায় তৈরি করে পুণে পুর সংস্থার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে বাড়ি-বাড়ি গিয়ে আবর্জনা সংগ্রহ করছেন। তাঁরা সেগুলি পৃথক করছেন এবং বিক্রি করছেন শিল্প সংস্থাগুলিতে পুনর্ব্যবহারের উদ্দেশ্যে। গোটা দেশেই এ ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কার্যকর ভূমিকা নিতে পারে।