দূরদর্শিতার অভাব
প্রতিযোগিতামূলক হিন্দুত্বের রাজনীতি প্রসঙ্গে লেখা ‘ক্ষতি’ (৩-৫) শীর্ষক সম্পাদকীয়টি যথোপযুক্ত। ওড়িশার পুরীর আদলে রাজ্য সরকারের অর্থানুকূল্যে পশ্চিমবঙ্গের দিঘায় জগন্নাথদেবের মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়েছে। বিতর্ক ও আইনের জটিলতা এড়াতে মন্দিরের পরিবর্তে নাম দেওয়া হয়েছে সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। এর পরে মন্দিরের আকর্ষণে হয়তো দিঘার পর্যটন শিল্পের লাভ হবে, কিন্তু আখেরে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় মন্দির নির্মাণে রাজ্যের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির বিশ্বাসযোগ্যতার বড় রকম ক্ষতি হল।
শাসক দল এক ঢিলে দু’টি পাখি মারতে চেয়েছে। এর ফলে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপির শাসক তৃণমূলের দিকে সংখ্যালঘু তোষণের যে অভিযোগটি আছে সেটা যেমন খণ্ডন হবে, তেমন মন্দির দেখিয়ে সংখ্যাগুরু হিন্দু সম্প্রদায়ের একাংশের সমর্থন নিজেদের দিকে হয়তো আবারও ফিরিয়ে আনা যাবে।
অভিপ্রায়টির মধ্যে দূরদর্শিতা নেই বলেই মনে করি। অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা গিয়েছে, এ রকম নরম হিন্দুত্বকে ব্যবহার করে কট্টর হিন্দুত্ববাদের মোকাবিলা করা যায়নি। অযোধ্যায় বিতর্কিত সৌধের তালা খোলা থেকে শুরু করে টিভিতে বছরের পর বছর রামায়ণ ও মহাভারত ধারাবাহিক দেখানোর পরও ১৯৮৪ সালের পর থেকে জাতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেস বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি। নির্বাচনের সময়ে রাহুল গান্ধী মন্দিরে মন্দিরে ঘুরলেও কংগ্রেসের পালে হাওয়া লাগেনি। অরবিন্দ কেজরীওয়ালও প্রকাশ্যে ‘হনুমান চল্লিশা’ পাঠের মাধ্যমে নরম হিন্দুত্বের তাস খেলেও দিল্লির রাজপাট রক্ষা করতে পারেননি। আদপে বিরোধী দলগুলোর এ সব কর্মকাণ্ডে লাভ হয়েছে বিজেপিরই। মেরুকরণের রাজনীতি হলে সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে মানুষের সমর্থন কট্টরপন্থীদের দিকেই যায়। সে ক্ষেত্রে বিজেপি প্রশ্নাতীত ভাবে সংখ্যাগুরু কট্টর হিন্দুদের সমর্থন লাভের প্রধান হকদার।
সাম্প্রতিক ধর্মীয় বিদ্বেষের আবহে রাজ্যে ধর্মবিযুক্ত রাজনীতির চর্চাই কাম্য ছিল। সেটাই বাংলার রাজনীতির ঐতিহ্য। যদিও দীর্ঘ বাম জমানার অবসানের পরের দেড় দশকে বাংলার রাজনৈতিক চালচিত্রের অনেক বদল ঘটেছে। অধুনা জীবন-জীবিকা রক্ষা বা অধিকার আদায়ের মতো বামঘেঁষা স্লোগান বাংলার রাজনীতির অঙ্গন থেকে অপস্রিয়মাণ। ‘জয় শ্রীরাম’ বা ‘খেলা হবে’-র মতো অরাজনৈতিক স্লোগানে আকাশ-বাতাস মুখরিত। হয়তো কিছু দিনের মধ্যে ‘জয় জগন্নাথ’ শব্দবন্ধও জনপ্রিয় হয়ে উঠবে এবং রাজ্য-রাজনীতির ময়দানে বার বার উচ্চারিত হবে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আগামী বিধানসভা নির্বাচনে গণদেবতার আশীর্বাদ কোন পক্ষ পায়, সেটাই দেখার!
কৌশিক চিনা
মুন্সিরহাট, হাওড়া