প্রতিযোগিতা
‘ক্ষতি’ শীর্ষক সম্পাদকীয়ের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। রাজ্য সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিতে এই মন্দির সকল জাত-পাত ধর্মের ঊর্ধ্বে থাকা মানুষের মহামিলন ক্ষেত্র এবং সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র!
বিজেপির সরাসরি সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মীয় রাজনীতির প্রতি আস্থায় যে ভারতের তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলিও গা ভাসিয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। হয়তো, সমর্থন হারানোর ভয়। তবুও শাসক-বিরোধী রাজনীতির মূলগত তফাত রয়েই যায়। দেশের বর্তমান শাসক দল সরাসরি সংখ্যাগরিষ্ঠের জামা গায়ে দিয়ে গর্বের সঙ্গে নিজেদের হিন্দুত্ববাদী বলে; এবং চরম হিন্দুত্বের রাজনীতি করে। অন্য দিকে বিরোধীরা ধর্মনিরপেক্ষতার জামা গায়ে দিয়ে সর্বধর্মসমন্বয়ের বার্তাটি ছড়িয়ে দিতে চেয়ে সংখ্যালঘুদের তোষণকারী হয়ে ওঠেন। আবার কখনও বিজেপির চরম সংখ্যাগুরুবাদের রাজনীতির বিরোধিতা করতে গিয়ে বিরোধী দলগুলি নরম হিন্দুত্ববাদের ধ্বজাধারী রূপেও প্রতিষ্ঠা পায়।
অর্থাৎ, তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ দল হিসাবে তারা ভাবের ঘরে চুরি করেই চলে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে জওহরলাল নেহরু বলেছিলেন, ধর্মপ্রাণ ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষ করে তোলাই এক চ্যালেঞ্জ। ইন্দিরা গান্ধীর সময়েও দেশ সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যালঘুর ভারসাম্যবাদেই ভোট-রাজনীতির পরিণতি খুঁজে পেয়েছে। সম্প্রতি অক্ষয় তৃতীয়ার দিনে পশ্চিমবঙ্গের নাগরিকদের এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হল। ২০২৪-এ নরেন্দ্র মোদীর অযোধ্যায় রামমন্দির উদ্বোধনের দিনে রামের প্রাণপ্রতিষ্ঠা; আর ২০২৫-এর এই দিনটিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিঘায় জগন্নাথ মন্দির উদ্বোধনে জগন্নাথ দেবের প্রাণপ্রতিষ্ঠা একাকার হয়ে গেল।
প্রতিযোগিতামূলক হিন্দুত্বের রাজনীতিতে রাজ্যের শাসক চেনা ছকেই আশ্রয় নিয়েছেন। স্বভাবতই বলা যায় যে; ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির জামাটি গা থেকে ঝেড়ে ফেলে রাজকোষাগারের অর্থে দেশ জুড়ে চরম হিন্দুত্ববাদ রাজনীতির একমাত্র প্রতিরোধী হিসাবে মান্য তৃণমূল নেত্রীর এই মন্দির রাজনীতি ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ রাজনীতির অন্তঃসারশূন্যতাকেই আরও বেশি প্রকট করে তুলল। বিশেষত, ধর্মীয় সংখ্যালঘুর প্রতি আস্থা এবং বিশ্বাসের বার্তা প্রেরণ করাই যখন সংখ্যাগুরুবাদের অন্যতম কর্তব্য রূপে বিবেচিত। চরম সংখ্যাগুরুবাদের সাগরে ভেসে চলা রাজ্যের শাসক দল যে ভোট-রাজনীতির স্বার্থেই ঐতিহ্যশালী ওড়িশার জগন্নাথ মন্দিরের কয়েকশো মাইলের মধ্যেই আরও একটি জগন্নাথ মন্দির স্থাপন করল, তা তো বোঝাই যাচ্ছে।
এখন সমস্যা হল, রাজনৈতিক নেতাদের দৈনন্দিন সংগ্রামে কখনও এগোতে হয়, কখনও পিছোতে হয়, মাঝে-মাঝে আত্মখণ্ডনও করতে হয়। কিন্তু এক জন সাধারণ নাগরিক বা কবি শিল্পী, যিনি প্রতি দিনের সংগ্রামে নেই, কিংবা জনতাকে পদে-পদে চালনা করার দায় যাঁদের নেই; তাঁরা তো এক বৃহত্তর লক্ষ্যে পৌঁছনোর ক্ষেত্রে নেতাদের প্রতিটি রাজনৈতিক পদক্ষেপের বিশ্লেষণ অবশ্যই করবেন, মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে।
রবীন্দ্রনাথও তেমনই স্বচ্ছ দৃষ্টি নিয়ে হিন্দু-মুসলমানের সমস্যাগুলিকে দেখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃবর্গের মতামতের সঙ্গে তাঁর মতামতও এক সময় সংঘাতের আকার নিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ যখন শুভবুদ্ধি এবং নৈতিক শিক্ষার মাধ্যমেই ভেদ-বুদ্ধি বিনাশে আশ্রয় নিতে চেয়েছিলেন; তখন রাজনৈতিক নেতারা হিন্দু-মুসলমান-শূদ্রদের মাঝে সংরক্ষণের মাধ্যমেই সমাজে এক সাম্যবাদ গড়ে তোলার প্রচেষ্টায় ব্রতী ছিলেন। অথচ, রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন রাজনীতির সংরক্ষণের মাধ্যমে ভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ভেদ বুদ্ধির বিনাশ করা যাবে না। তিনি মনে করতেন— সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা সম্প্রদায়কে বিভক্ত করে দুর্বল করবে, সাময়িক শান্তির জন্য এটাকে প্রশ্রয় দেওয়াও কাজের কথা নয়। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “দেশের যে অতি ক্ষুদ্র অংশে বুদ্ধি, বিদ্যা, ধন, মান সেই শতকরা পাঁচ পরিমাণ লোকের সঙ্গে পঁচানব্বই পরিমাণ লোকের ব্যবধান মহাসমুদ্রের ব্যবধানের চেয়ে বেশি।”
এই ৫ শতাংশ লোকই তাঁদের সুবিধামতো ৯৫ শতাংশকে চালিত করে এবং মাঝেমধ্যেই দাঙ্গা বাধায়। আর এ ভাবেই সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীগুলির মধ্যে অবিশ্বাস গড়ে ওঠে এবং পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধ হয়ে দাঁড়ায়। এর কোনও সমাধান হয়তো নেই!
সঞ্জয় রায়
দানেশ শেখ লেন, হাওড়া
আত্মবিশ্বাস?
সম্পাদকীয় ‘ক্ষতি’ পড়ে একটি প্রশ্ন তুলতে চাই। গত সব ক’টি নির্বাচনে দেখা গিয়েছে যে, বিজেপি-শাসিত কিছু রাজ্যের থেকে শিক্ষা, কর্মসংস্থানে পিছিয়ে থাকলেও, এ রাজ্যের সংখ্যালঘু ভোট এককাট্টা হয়ে স্বঘোষিত ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ তৃণমূলের ঝুলিতে এসেছে। তাই কি রাজ্যের শাসক দল এখন নিশ্চিন্ত হয়েছে যে, এ বার তারা জনগণের করের টাকায় সংখ্যালঘু তথা দরিদ্র মানুষের উন্নয়ন না করে ধর্মস্থল তৈরি করে চললেও, কেউই কোনও প্রশ্ন তুলবেন না?
নিকুঞ্জবিহারী ঘোড়াই
কলকাতা-৯৯