একটা রোগের দ্রুত বৃদ্ধির খবর কপালে ভাঁজ ফেলেছে চিকিৎসকদের। চার দশক আগে জানা গিয়েছিল, বড়দের যে ধরনের ডায়াবিটিস হয়, তা থাবা বসাতে শুরু করেছে শিশুদের দেহে। রোগের পরিচয় ‘ম্যাচিয়োরিটি-অনসেট ডায়াবিটিস অব দ্য ইয়াং’, সংক্ষেপে ‘মডি’। ভারতে সবচেয়ে কমবয়সি রোগীর বয়স তখন ছিল ষোলো। জন্মের সময় থেকেই শিশুর ইনসুলিন-নির্ভরতা থেকে একেবারে আলাদা এই ‘মডি’। সম্প্রতি মাত্র আট বছরের শিশুর মধ্যেও ‘মডি’ পাওয়া গিয়েছে। দ্রুত বাড়ছে শিশু-কিশোরদের মধ্যে বড়দের ‘টাইপ ২’ ডায়াবিটিস।
শিশুদের মধ্যে সাধারণত যে ডায়াবিটিস দেখা যায়, তা ‘টাইপ ওয়ান’ নামে পরিচিত। সেখানে অগ্ন্যাশয়ের নির্দিষ্ট কিছু কোষ থেকে ইনসুলিন নামের হরমোন জন্মগত কারণে তৈরিই হতে পারে না এই শিশুদের শরীরে। ইনসুলিন আবিষ্কারের আগে জন্মগত ভাবে ইনসুলিন-নির্ভর ডায়াবিটিসে আক্রান্ত হয়ে অনেক শিশু মারা যেত। ১৯২২ সালে ফ্রেডেরিক বেন্টিং ও চার্লস বেস্ট ইনসুলিন আবিষ্কারে সফল হয়েছিলেন। কানাডার টরন্টো শহরের এক হাসপাতালে মরণাপন্ন সাত বছরের একটি শিশু প্রথম ইনসুলিন প্রয়োগে প্রাণ ফিরে পায়। তার পর থেকে এক শতাব্দী ধরে জন্মগত ভাবে ডায়াবিটিসে আক্রান্ত লক্ষ লক্ষ শিশুর প্রাণ বাঁচিয়েছে ইনসুলিন।
কিন্তু এখন দেখা দিয়েছে নতুন সঙ্কট— বড়দের ডায়াবিটিস হানা দিতে শুরু করেছে শৈশবেই। এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও (হু)। ২০২১-এ শিশু-কিশোরদের মধ্যে ‘টাইপ ২’ ডায়াবিটিসের অনুপাত ছিল এক লক্ষে ৩৯৭, যা বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম। আক্রান্ত শিশুদের সংখ্যার নিরিখে প্রথম তিনটি দেশ হল চিন, ভারত এবং আমেরিকা। এর একটি প্রধান কারণ শিশুদের ওজনে বৃদ্ধি। ভারতে বেশি ওজন (ওভারওয়েট) এবং অত্যন্ত বেশি ওজন (ওবিসিটি) পাওয়া যাচ্ছে কিশোরদের মধ্যে ১২ শতাংশ, এবং মেয়েদের মধ্যে আট শতাংশ। সমীক্ষায় পাওয়া গিয়েছে যে, কয়েক দশকের মধ্যে শিশু-কিশোরদের ওজন বৃদ্ধির হার দ্রুত বেড়েছে, বিশেষত শহরে। ওজন বৃদ্ধির ফলে টাইপ ২ ডায়াবিটিসের ঝুঁকি বাড়ে, এবং ডায়াবিটিস বাড়ায় নানা ধরনের রোগের ঝুঁকি— উচ্চ রক্তচাপ, হৃদ্রোগ, স্ট্রোক প্রভৃতি। চোখ, কিডনি, স্নায়ুও আক্রান্ত হতে পারে। টাইপ ১ ডায়াবিটিসের চেয়ে শিশুদের মধ্যে টাইপ ২ ডায়াবিটিসের ক্ষতি করার ক্ষমতা অনেক বেশি। কম বয়সে হৃদ্রোগ এবং ফ্যাটি লিভার-এর সমস্যা তৈরি করে টাইপ ২ ডায়াবিটিস। ঠিক মতো চিকিৎসা না পেলে অকালমৃত্যুর সম্ভাবনা যথেষ্ট। তাই শৈশব-কৈশোরে ডায়াবিটিসকে সর্বশক্তিতে প্রতিরোধ করা দরকার।
অথচ, ভারতে এ নিয়ে কতটুকু মাথাব্যথা দেখা যায়? ‘ডায়াবিটিসের রাজধানী’-র শিরোপা নতুন সহস্রাব্দের শুরুতেই জুটেছে ভারতের! সমস্যার শুরু শিক্ষাব্যবস্থাতেই। শিক্ষার নামে ছাত্রদের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে একের পর এক অমানবিক বোঝা। স্কুল থেকে ফিরে খেলাধুলো, ছুটোছুটি না করে ছেলেমেয়েরা যাচ্ছে টিউশন পড়তে। স্কুলগুলো ছাত্রছাত্রীদের উপর ‘প্রোজেক্ট’ চাপিয়ে দেওয়ার আগে ভেবে দেখেন না, স্কুলে বসে পড়াশোনা, বাড়ি বসে পড়ার পরে আবারও বসে বসে প্রোজেক্ট তৈরির কী প্রভাব হতে পারে স্বাস্থ্যের উপর। শিশুর পাশাপাশি মা-বাবাও কর্মব্যস্ত। তাই তাঁরা ঝুঁকছেন শিশুকে চটজলদি, সুস্বাদু খাবার কিনে দেওয়ার দিকে। প্রচুর শর্করাযুক্ত প্যাকেটজাত খাদ্যে আসক্ত হচ্ছে শিশুরা।
শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য পরীক্ষার নম্বর নয়, শিশুর মানসিক, শারীরিক ও বৌদ্ধিক বিকাশ। কিন্তু তা মনে করিয়ে দিলে ক্ষুব্ধ হন অধিকাংশ অভিভাবক। বাঙালির দ্বিচারিতা অন্তহীন। পঁচিশে বৈশাখ রবীন্দ্রনাথের ছবিতে মালা পরাই, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের শিক্ষার আদর্শ জেনেও ভুলে থাকি। মুক্ত চিন্তা, অবাধ প্রান্তরে শিশুদের ছোটাছুটি, খেলাধুলো, নাচগানের তালিমের মধ্যে দিয়ে যে সার্বিক শিক্ষার আদর্শ তৈরি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তা প্রত্যাখ্যান করেছে পরবর্তী প্রজন্মগুলি। শহর থেকে উধাও হয়েছে খেলার মাঠ। বিনোদন ধরা পড়ে গিয়েছে টিভি আর মোবাইলের পর্দায়। কেবল চিন্তার সঙ্কীর্ণতা নয়, এর প্রভাব পড়ছে শিশুর স্বাস্থ্যের উপরেও।
আন্তর্জাতিক সমীক্ষাতেও ধরা পড়েছে, শিশুদের ডায়াবিটিসে আক্রান্ত হওয়ার অনেক কারণের অন্যতম স্মার্টফোনে আসক্তি। ইন্ডিয়ান জার্নাল অব পেডিয়াট্রিকস-এ প্রকাশিত একটি সাম্প্রতিক গবেষণাপত্রে লেখকরা শৈশবে ওজন বৃদ্ধির তিনটি কারণকে বিশেষ ভাবে চিহ্নিত করেছেন— অতিরিক্ত ক্যালরি-সম্পন্ন খাবার, শারীরিক ক্রিয়াকর্মে হ্রাস, আর তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে সতর্কতার অভাব। অতিশৈশব থেকে বাচ্চাদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে স্মার্টফোন। ফোনে ভিডিয়ো গেম, ভিডিয়ো দেখতে দেখতে চলমান ছবিকে বিনোদন ভাবছে শৈশব। কর্মব্যস্ত অভিভাবক শিশুকে ভুলিয়ে রাখতে, বিশেষত খাওয়ানোর সময়ে, তার হাতে স্মার্টফোন তুলে দিচ্ছেন। না হলে টিভি চ্যানেলগুলোর সামনে বসে থাকা শিশুর মুখে খাবার ঠেসে দিচ্ছেন। এই সব অভ্যাস থেকে মুক্তির অনুশীলন করতে হলে কেবল শিশুকে নয়, গোটা পরিবারকেই চেষ্টা করতে হবে। মোবাইল ব্যবহার, টিভি দেখার নির্দিষ্ট সময়সীমা মেনে চলা জরুরি পরিবারের সবার জন্যেই। মনে রাখতে হবে, টিভি, মোবাইল-সর্বস্ব জীবন কেবল শৈশবের ডায়াবিটিসই নয়, শিশুকে নানা ভাবে বিপন্ন করে। তার মধ্যে রয়েছে মানসিক স্বাস্থ্য— একাকিত্ব, বিষাদে আক্রান্ত হওয়া। অতিরিক্ত উদ্বেগ, সামান্য কারণে অত্যন্ত হতাশা, এ সবই তার ফল। শিশু-কিশোরদের ‘টাইপ ২’ ডায়াবিটিসে আক্রান্ত হওয়া এক গভীর সামাজিক অসুখের লক্ষণ।