লোহার খাঁচার গাড়িতে এক বছর-বয়সি তিন সন্তান। তাদের নিয়ে পথে পথে ঘুরছেন মা। মায়ের পিছনে খাঁচা গাড়িটি ধরে ছুটে চলেছে চার বছরের মেয়ে। সন্তানদের নিয়ে দিশেহারা মা সকাল হলেই এ ভাবে লোকের দোরে দোরে ঘুরে বেঁচে থাকার রসদ জোগাড় করেন।
সম্প্রতি বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁওয়ে জান্নাত বেগমের এই লড়াইয়ের গল্প সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। পোশাক কারখানায় কাজ করতেন ময়মনসিংহের মেয়ে জান্নাত। ঠাকুরগাঁওয়ে বিয়ের পর প্রথমে একটি মেয়ের জন্ম দেন। পরে এক সঙ্গে আরও তিনটি সন্তান জন্মালে স্বামী ছেড়ে চলে যায়। অথৈ জলে পড়েন জান্নাত। সন্তানদের একা রেখে কাজে বেরোনো অসম্ভব। তাই বুদ্ধি করে কামারের দোকান থেকে লোহার খাঁচায় চাকা লাগিয়ে গাড়ি বানিয়েছেন। ভিক্ষা করে জীবন চালাতে তাঁর বড়ই লজ্জা। লোকের বাড়ি কাজের ডাকও পান। কিন্তু বাচ্চাগুলোকে কে দেখবে! উপায়ন্তর না দেখে ভিক্ষাবৃত্তিই সম্বল। লাখ টাকায় সন্তানদের বিক্রির প্রস্তাবও পেয়েছেন। কিন্তু সন্তানের মায়ার কাছে হার মেনেছে টাকার প্রলোভন।
জান্নাতের জীবনের গল্প কল্পনাকেও হার মানায়, নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে সন্তানকে বাঁচাতে একা মায়ের লড়াইয়ের প্রচেষ্টা। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, জীবনের কোনও বাঁকে মুখ থুবড়ে পড়লে এক মা কী ভাবে খড়কুটো আগলে ধরে ঘুরে দাঁড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে।
এ বছরের গোড়ায় সমাজমাধ্যমে ছড়িয়েছিল আর এক মায়ের ছবি। রেলওয়ে সুরক্ষা বাহিনীর কনস্টেবল রিনা লাঠি হাতে দিল্লি স্টেশনে নিরাপত্তার কাজে ব্যস্ত। বুকে বাঁধা এক বছরের শিশু সন্তান। হয়তো প্রতি দিনই তিনি এ ভাবে ডিউটি করেন। রিনার ছবি ভাইরাল হয়েছিল, কারণ তার আগের দিনই কুম্ভমেলায় যাওয়ার ভিড়ে সেই স্টেশনেই পদপিষ্ট হয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন ১৮ জন। দুর্ঘটনার পর দিন দুধের শিশুটিকে বুকে বেঁধে সেই অকুস্থলে দাঁড়িয়ে কাজ করতে মায়ের বুক কেঁপেছিল কি না জানি না। কিন্তু এ নিশ্চিত করে বলা যায় নিতান্ত নিরুপায় না হলে মা এই রাস্তা বেছে নিতেন না। বাধ্য হয়েই বহু মা ঝুঁকিপূর্ণ কর্মস্থানে সন্তানদের নিয়ে যান। কর্তব্যের মাঝে সন্তানকে আগলে রাখেন বাহুডোরে।
বহু মায়ের কাছে এ সব নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। সন্তানের জন্য অর্থ ও সুরক্ষা দুই-ই প্রয়োজন। দুটোকে মেলাতে মায়েদের এই পথ বেছে নিতে হয়। ছোটবেলায় দেখতাম বাড়িতে কাজ করতে আসা বকুলমাসি সঙ্গে করে নিয়ে আসত নিজের ছোট দু’টিকে। এক কোণে মুড়ির বাটি দিয়ে বসিয়ে দিত। ঝটপট এক বাড়ি সেরে অন্য বাড়ি ছুটতে হবে। সব কাজের বাড়িই যে ব্যাপারটি সুনজরে দেখত, তা তো নয়। কারও কাছে এ ছিল উটকো জ্বালাতন। তারা কথা শোনাতেও ছাড়ত না। কাঁচুমাচু মুখে বকুলমাসি উত্তর দিত, “কী করব বল, একা ঘরে তো ফেলে রাখতে পারি না।” নিরুপায় হয়েই চা বাগানে বহু মা সন্তানকে বুকে বেঁধে পাতা তোলেন। ইটভাটার মায়েরা সন্তানের কোমরে দড়ি বেঁধে তাকে দিনভর গনগনে আঁচের পাশে বসিয়ে রাখতে বাধ্য হন। তবু তো সন্তান চোখের সামনে থাকবে।
ধ্যানধারণা ধীর গতিতে বদলালেও সন্তান প্রতিপালনের মূল দায়িত্বটি আজও মায়ের উপর বর্তায়। এ যেন এক অলিখিত শর্ত। বাবা আর্থিক সাহায্য ও তার থেকে আর একটু বেশি কিছু করতে পারেন। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। কিন্তু সিংহভাগ ক্ষেত্রেই সন্তানের দেখভাল ও সুরক্ষার দায়িত্বটি অবশ্যই মায়ের। কখনও বা সেটা হয়ে দাঁড়ায় একা মায়ের লড়াই। তাই বাবার বর্তমানেও বহু মা’কে সন্তানের সুরক্ষায় কঠিন পদক্ষেপ করতে হয়।
পাঁচ বছরের একমাত্র ছেলে কথা বলতে পারে না। ছেলের চিকিৎসার অর্থ জোগাতে নেপালের মেয়ে বছর বাইশের মায়া গৃহপরিচারিকার কাজে পাড়ি দিয়েছিলেন বেঙ্গালুরু। পরে আরও অর্থ জোগাড়ের আশায় দুবাই। ছেলেকে রেখে এসেছেন দিদিমার জিম্মায়। দিনে এক বার ছেলের সঙ্গে কথা বলতে পারেন কিছুক্ষণের জন্য। কোনও এক দিন ছেলে কথা বলবে, স্কুলে যাবে, এই আশায় দূর দেশে তিনটি বছর পার করে দিয়েছেন।
সে এক সময় ছিল, যখন ধরেই নেওয়া হত পরিবারে পুরুষটিরই দায়িত্ব অর্থ উপার্জন। পরিস্থিতি বদলেছে। শুধু উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্ত পরিবারেই নয়, নিম্নবিত্ত ও অতি-নিম্নবিত্ত পরিবারের মহিলারা সন্তানের একটু স্বাচ্ছন্দ্যের আশায় বছরের পর বছর ঘর ছাড়ছেন। আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর হতদরিদ্র পরিবারের মহিলারা গৃহপরিচারিকা বা সাফাইকর্মীর কাজে পাড়ি দিচ্ছেন ভিন দেশে।
এঁদের গল্পগুলো মোটামুটি একই। ২০১৫-এর ভূমিকম্প বাড়ি-ঘর সব কেড়ে নিয়েছিল নেপালের নির্মলা রাইয়ের। একমাত্র ছেলের পড়াশোনা বন্ধ হওয়ার জোগাড়। হাল ধরতে সাফাইকর্মীর কাজ নিয়ে নির্মলা গিয়েছিলেন অজানা অচেনা কাতার-এ।
প্রায় একই গল্প বাংলাদেশের শরিয়তগঞ্জের আলিয়া বিবির। মুড়ি ভেজে দিনমজুর স্বামীকে সাহায্য করতেন। তবু সংসারে নিত্য টানাটানি। দুই ছেলের মুখে ঠিকমতো খাবারও তুলে দিতে পারেন না। গ্রামের কিছু মেয়ে দূর দেশে কাজে গেছে। এক দিন সাহস আর টাকা জোগাড় করে স্বামী আর ছেলেদের রেখে আলিয়া দেশ ছেড়েছিলেন। দশ বছর ঠিকে কাজ করে সংসার টানছেন। দেশে ছেলেরা কলেজে পড়ছে।
এই মায়েদের বেশির ভাগেরই অক্ষরজ্ঞান নেই। কিন্তু জীবন তাঁদের শিখিয়েছে লেখাপড়ার তাৎপর্য। আলিয়া বিবির কথায়, তাঁর শ্বশুরের নয় নয় করেও কিছু জমিজমা ছিল। জ্ঞাতিরা কাগজ বানিয়ে টিপছাপ নিয়ে সে সব কেড়ে নিয়েছে। লেখাপড়া জানলে এমনটা কি করতে পারত? আলিয়া তাই কোনও ভাবেই ছেলেদের লেখাপড়া বন্ধ করতে দিতে চাননি। স্বামীর সঙ্গে অনেক ঝগড়া-অশান্তির পর অভ্যাসের ঘেরাটোপ থেকে নিজেকে বার করে এনে ফেলেছিলেন অজানার পথে।
শ্রীলঙ্কার এক মা নিমিষার কাছে অবশ্য অন্য কোনও উপায় ছিল না। ক্যানসারে আক্রান্ত স্বামীর চিকিৎসায় সর্বস্বান্ত হয়েছিল নিমিষার পরিবার। স্বামী যখন মারা গেলেন দেশের অবস্থা টালমাটাল। ছোট দুই ছেলেমেয়েকে শাশুড়ির কাছে রেখে নিমিষা এক দিন ধরেছিলেন আবু ধাবির বিমান। কিন্তু দেশের পরিস্থিতি নিমিষাকে আরও একটু বেশি ভাবিয়েছিল। দেশে সন্তানদের ভবিষ্যৎ কী? তাই কয়েক বছর আবু ধাবিতে কাজের পর ইটালির ভিসা জোগাড় করেন। সেখানই গৃহপরিচারিকার কাজ করছেন। আশায় আছেন, সুদূর ভবিষ্যতে সন্তানদেরও ইউরোপে নিরাপদ আশ্রয় দিতে পারবেন।
কত কত নির্মলা, মায়া, নিমিষা সন্তানের সুরক্ষার প্রশ্নে নিত্য দিন পাড়ি দিচ্ছেন অচেনা অজানা দেশে, তার ইয়ত্তা নেই। তবে এমন আরও বহু সংখ্যক মা আছেন, যাঁরা ওঁদের মতো বিপন্ন হননি। এতখানি সাহসীও হতে হয়নি তাঁদের। কিন্তু সন্তানের মুখ চেয়ে নিজের জন্য কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাঁরা। বাইরের পেশার জগৎকে বিদায় জানিয়ে আর্থিক স্বাধীনতাহীন গৃহবধূতে পরিণত হয়েছেন। স্বার্থত্যাগ করেছেন সন্তানের স্বার্থে।
এই সব মায়ের দশ হাত নেই, দু’টি হাতেই প্রাণপণে আঁকড়ে থাকেন, আগলে রাখেন সন্তানদের। নিজের মতো করে, সীমিত সামর্থ্যে। সেই কোন কালে সত্যবতী কন্যা সুবর্ণলতাকে সমাজের আগ্রাসন থেকে রক্ষা করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। পিতৃতান্ত্রিক সমাজের অন্ধকূপ থেকে বার করে মেয়েকে আলোর দিশা দেখাতে চেয়েছিলেন। আপাত ভাবে সত্যবতী ব্যর্থ হয়েছিলেন। সংসার ত্যাগ করেছিলেন বালিকা সুবর্ণর বিয়ের পর। অনন্তকাল ধরে মায়েদের এমনতর লড়াই চলে এসেছে। ব্যর্থতা বা সফলতার হিসেব সময় করবে। কিন্তু মায়ের নিরন্তর লড়াই চলতেই থাকবে।