সেপ্টেম্বরের মধ্যেই সবুজ বাজি উৎপাদন ও বিক্রির ৯৪৫টি আবেদনের নিষ্পত্তি করার নির্দেশ ছিল রাজ্য সরকারের শীর্ষ বৈঠকে।
মুখ্যসচিবের নেতৃত্বে সেই বৈঠকে ঘোষণা হয়েছিল, এ বার আর দেরি নয়, সবুজ বাজি ক্লাস্টার গঠন থেকে উৎপাদন ও বিক্রির লাইসেন্স অনুমোদন— সবই সম্পূর্ণ করতে হবে সেপ্টেম্বরের মধ্যে। কিন্তু সরকারি নথিই এখন বলছে, সময়সীমা
পেরিয়ে গেলেও সেই প্রতিশ্রুতি আজও কাগজেই বন্দি। সিদ্ধান্ত হয়েছে, বৈঠক হয়েছে, ফাইল ঘুরেছে। কিন্তু কাজ? হয়নি।
সরকারি রিপোর্টেই স্পষ্ট, ৯৩টি উৎপাদনের আবেদন ও ৮৫২টি বিক্রির আবেদন— মোট ৯৪৫টি ফাইলের নিষ্পত্তি নিয়ে কোনও অগ্রগতি নেই। গত ২৯ অগস্ট বৈঠকে
মুখ্যসচিবের উপস্থিতিতে ১০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে অনুমোদন সম্পূর্ণ করার যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, তার বাস্তবায়ন হয়েছে কিনা, তা-ও সরকারি নথিতে অজানা। অর্থাৎ, এক মাসের মধ্যে রাজ্যের বাজি শিল্পে শৃঙ্খলা ফেরানোর আশ্বাস শেষ পর্যন্ত রয়ে গেল প্রশাসনিক প্রতিশ্রুতির পাতাতেই।
প্রশাসনিক সূত্রের খবর, রাজ্যের শিল্পসাথী পোর্টালে এখনও ঝুলে রয়েছে ৫৮১টি আবেদন। রাজ্য সরকারের ব্যাখ্যা, “আবেদনকারীরা প্রয়োজনীয় নথি বা টাকা জমা দেননি।” কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, মুখ্যসচিবের সরাসরি নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও প্রশাসন কী ভাবে দায় ঝেড়ে ফেলছে? প্রশাসনের একাংশেরই মত, এটি কেবল গাফিলতি নয়, এটি সরাসরি নির্দেশ অমান্য করা।
সরকারি নথি জানাচ্ছে, হলদিয়ার পরীক্ষাগারে সবুজ বাজির মান যাচাইয়ের দায় রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদকে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই কাজের কোনও অগ্রগতি হয়েছে কিনা, তা নিয়ে নথিতে নেই কোনও হদিস। অর্থাৎ, নির্দেশ দেওয়া হলেও তা কার্যকর করার তাগিদ নিয়ে প্রশ্ন থাকছে।
একই ছবি সবুজ বাজি ক্লাস্টার প্রকল্পের ক্ষেত্রেও। সরকারি নথি বলছে, উত্তর ২৪ পরগনা, দার্জিলিং, পশ্চিম মেদিনীপুরে প্রাথমিক অনুমোদনের উল্লেখ থাকলেও, জলপাইগুড়ি, মুর্শিদাবাদ, হাওড়া ও পূর্ব মেদিনীপুরে এখনও জমি চিহ্নিতকরণই সম্পূর্ণ হয়নি। রাজ্যের ঘোষিত ‘পরিবেশবান্ধব বাজি শিল্প গড়ার পরিকল্পনা’ এখন কার্যত কল্পনা মাত্র।
এমনকি, কলকাতার আশপাশে স্থায়ী বাজি বাজার তৈরির
সিদ্ধান্তও আজ কেবল ফাইলে বন্দি। প্রকল্পের নাম আছে, পরিকল্পনা আছে, কিন্তু কাজ নেই। সরকারি সূত্রের বক্তব্য, “প্রকল্প নিয়ে
আলোচনা হয়েছিল, কিন্তু কে বাস্তবায়ন করবে, তা নির্ধারণ হয়নি।” অর্থাৎ, দায় কারও নয়, ফলাফলও শূন্য।
সবুজ বাজির প্রকৃত নির্মাতাদের যাচাইয়ের ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে একই গাফিলতি। সিএসআইআর–নিরির অনুমোদিত ২২৮টি বৈধ প্রতিষ্ঠানের তালিকা জেলা প্রশাসনের হাতে পৌঁছনোর কথা ছিল। কিন্তু
সরকারি সূত্র বলছে, তা আদৌ পৌঁছেছে কিনা, তারও প্রমাণ নেই। ফলে প্রশ্ন উঠছে, যখন বৈধ নির্মাতাদের তথ্যই স্পষ্ট নয়, তখন রাজ্য ‘গ্রিন ক্র্যাকার’ উৎপাদনের দাবি করছে। এ কি প্রশাসনিক কৌতুক নয়? এক প্রবীণ প্রশাসনিক কর্তার কটাক্ষ, “রাজ্যের নথিই এখন বিরোধী সাক্ষী। মুখে সংস্কারের দাবি, নথিতে স্থবিরতা— এই ফাঁকটাই আজকের প্রশাসনিক বাস্তবতা।”
এক পরিবেশবিদের ভাষায়, “সবুজ বাজি প্রকল্প রাজ্য সরকারের পরিবেশবান্ধব উদ্যোগের প্রতীক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা এখন সরকারি ব্যর্থতার উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বৈঠক হয়েছে, নির্দেশ বেরিয়েছে, ফাইল ঘুরেছে—কিন্তু কাজ কোথাও হয়নি।”
‘সবুজ মঞ্চ’-এর সম্পাদক নব দত্ত বলছেন, “যখন সরকারি নথিই জানাচ্ছে নির্দেশ আছে, কিন্তু কাজ নেই, তখন আর দায় চাপানোর জায়গা কোথায়? সেপ্টেম্বরের প্রতিশ্রুতি অক্টোবরে প্রশাসনিক ব্যর্থতার প্রতীকে পরিণত।”
রাজ্যের উচ্চ পর্যায়ে মুখে বলা হচ্ছে, “প্রক্রিয়া চলছে।” কিন্তু সরকারি নথিই যেন সব চেয়ে স্পষ্ট সাক্ষী— প্রক্রিয়া ‘চলছে’ বহুদিন ধরেই, কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছনোর কোনও ইঙ্গিত এখনও নেই।